কোরবানির বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে

কোরবানির বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে

প্রতি বছরই ঢাকা মহানগরীসহ দেশের সর্বত্র কোরবানি ও এর বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বর্জ্যসমূহ সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব হয় না। মক্কার আদলে কোরবানি ও এর বর্জ্য যদি যথাযথ ব্যবস্থাপনায় আনা যায় তবে কোরবানি পরবর্তী পরিবেশ দূষণ যেমন রোধ করা যাবে অন্যদিকে জবাই পরবর্তী উচ্ছিষ্ঠাংশ সমূহকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে। চলমান অব্যবস্থাপনার বিপরীতে কোরবানি ও এর বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করণে করণীয় নির্ধারণে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর উদ্যোগে ২৩ আগস্ট ২০১৬, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

পবার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এম সফিউল্লাহ এর সভাপতিত্বে এবং পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরীর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, সহ-সম্পাদক আবুল হাসনাত, মো: সেলিম, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি রাজিয়া সামাদ প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, পরিচ্ছন্নতাকে ইসলাম ধর্মে অতীব গুরুত্ব প্রদান করেছে। নি:সন্দেহে পরিচ্ছন্নতার প্রসঙ্গটি কোরবানির ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রযোজ্য। অথচ আমরা প্রতি বছর দেখছি যত্রতত্র পশু জবাই করা হচ্ছে। পশুর রক্ত ও আবর্জনায় রাস্তাঘাট সয়লাব। ড্রেনে পানির প্রবাহ আটকে যাচ্ছে, উপচে পড়া নোংরা পানি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামাঞ্চলে কোরবানির বর্জ্য খোলা স্থান, ঝোপঝাড়ের পাশে, খালে-বিলে বা নদীতে ফেলা হয়। সব মিলিয়ে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটে। রোগ বিস্তারও ঘটতে থাকে। কোরবানি ঈদের বেশ কয়েকদিন পর পর্যন্ত দূর্গন্ধে নগর-জনপদের বাতাস ভারী থাকে। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদের পরে রোগবালাইয়ের হার কতটা বেড়ে যায় তার উপর কোন গবেষণা করা হয়নি।

পবিত্র মক্কা নগরীর আদলে কোরবানির কতোগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- কোরবানির জন্য নির্ধারিত স্থান থাকবে। জায়গাটি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হবে। কোরবানির পশুটিকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হবে। পশুটি রোগমুক্ত এবং কোরবানির উপযুক্ত কিনা সেটাও পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। একটি পশুর সামনে অন্য আরেকটি পশুকে জবাই করা হবে না। এমনকি নির্বাচিত পশুর সামনে জবাইয়ের ছুরি ধার দেয়াও যাবে না। জবাইয়ের পর পশুর রক্ত প্রবাহিত হওয়ার স্থান থাকতে হবে। প্রশিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা পশু জবাই করানো হবে। পশুর মালিক দক্ষ হলে নিজের পশু নিজেই জবাই করতে পারবেন। সর্বোপরি কোরবানির বর্জ্য সংগ্রহের একটি সুষ্ঠু ও কার্যকর পদ্ধতি বা সিস্টেম থাকবে। এ ছাড়া কোরবানি সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধি বিধানের প্রয়োগের ব্যবস্থাদি থাকতে হবে।

সম্প্রতি সরকারি কিছু উদ্যোগে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠতে শুরু করেছি। গত বছর কোরবানি ঈদের সময় সরকার ঢাকাসহ কিছু স্থানে কোরবানির পশু জবাইয়ের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। এ বছরও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে পশু কোরবানির জায়গা নির্ধারিত করা হয়েছে। আমরা এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।


ইসলাম ধর্মে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অথচ প্রতি বছর আমাদের অজ্ঞতা ও অব্যবস্থাপনার দরুণ কতো হাজার হাজার টন কোরবানির পশু বর্জ্যরে অপচয় আমরা করছি তার হিসাবটিও রাখছি না। গত বছর পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় ৭০ লক্ষ গুরু কোরবানির সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করেছিল। নি:সন্দেহে এবার সে সংখ্যাটি আরো বাড়বে। এর সাথে যুক্ত হবে ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। সব মিলিয়ে এবার দেড়কোটির মতো পশু কোরবানির সম্ভাবনা রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক পশু থেকে বিশাল পরিমাণের বর্জ্য উৎপাদিত হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এই বিপুল বর্জ্যরে মধ্যে চামড়া ব্যতীত পশুর অন্যান্য বর্জ্যের বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে যাবে।


কোরবানির পশু থেকে উৎপন্ন বর্জ্য হচ্ছে- চামড়া, শিং, খুর, লেজ ও লেজের লোম, হাড় ও রক্ত, নাড়িভুড়ি, গোবর ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে চামড়া হচ্ছে সবচেয়ে দামি। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ ও কিশোর বয়সী মাদ্রাসা ছাত্রদের দ্বারা পশু কোরবানি করার দরুণ জবাইকৃত পশুটি কষ্ট পায়। মহানবী (সা) এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করছেন। এদর অদক্ষ হাতে জবাইয়ের স্থানের চামড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশুর চামড়া ছাড়ানোর ক্ষেত্রেও অপটু অদক্ষ লোকের হাতে মূল্যবান চামড়ার প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে।

চূড়ান্তভাবে যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। চামড়া ব্যতীত অন্যান্য বর্জ্যকে ব্যবহারের ভাবনা সরকারি বেসরকারি কোন পর্যায়েই নেই। অথচ রক্ত, হাড়, খূর, শিং, লেজের লোম ও অন্যান্য বর্জ্য থেকে সার, বোতাম, চিরুনী, পশুখাদ্য, মৎস খাদ্য, হাসমুরগির খাদ্য ইত্যাদি খুব সহজেই উৎপন্ন করা যায়। আরো কিছু শিল্পে এগুলো ব্যবহৃত হতে পারে। আজকের পৃথিবীতে স্বাবলম্বী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে অগ্রসর হতে হলে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। তবে কোরবানির বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার বড় বাঁধা হলো এসব বর্জ্যকে সংগৃহীত করা।

সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সুপারিশ হলো-
১. ঘোষণাকৃত নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে কাজটি শুরু করতে হবে। সামাজিক সংগঠন ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।


২. যত্রতত্র পশু কোরবানি বন্ধে জনসাধারণকে বোঝানোর জন্য ভ্রাম্যমান টিম ঈদ ও ঈদের পর দুইদিন কাজ করবে। পরপর তিন বছর এই প্রক্রিয়া চলার পর চতুর্থ বছর থেকে শাস্তির বিধানসহ ভ্রাম্যমান আদালতের ব্যবস্থা করা হবে।


৩. প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে জনসংখ্যা অনুপাতে ইসলাম সম্মতভাবে পশু জবাইয়ের জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। এরা নির্দিষ্ট ফি-র বদলে নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাই করবে। এ দায়িত্ব ধর্ম মন্ত্রণালয় পালন করতে পারে। আঠারো বছরের কম কাউকে দিয়ে পশু জবাই নিষিদ্ধ করতে হবে।


৪. পশু জবাইয়ের নির্ধারিত স্থান থেকে পশু-বর্জ্য (চামড়া, হাড়, রক্ত, খুর, শিং, লেজের লোম, নাড়িভুড়ি, গোবর ইত্যাদি) সংগ্রহ করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় সরকারের থাকবে। এগুলোকে শিল্পে রূপান্তরের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। অথবা পুরো প্রক্রিয়াটি পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশীপ (চচচ) এর মাধ্যমে করা যেতে পারে।


এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে একদিকে ইসলামসম্মত কোরবানি নিশ্চিত করা হবে অন্যদিকে কোরবানির অব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যহানির অবসান হবে। কোরবানির বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করা গেলে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তাতে দারিদ্র্যের হার আরোও হ্রাস পাবে। আমরা হিসাব করে দেখেছি বর্তমানে একটি মাঝারি আকারের গরুর কোরবানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চার থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। পবিত্র মক্কা নগরীর আদলে কোরবানির ব্যবস্থা করা হলে এই খরচ চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এতেও সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।