ট্যানারী স্থানান্তরে ব্যর্থদের প্লট বাতিল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিছিন্নসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক

ট্যানারী সাভারে স্থানান্তর এবং পরিবেশসম্মতভাবে পরিচালনা করা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে পবার পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শনে দেখা যায় যে, সিইটিপির দুটি মডিউলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও বর্জ্যরে অভাবে তা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিল্প ভবন নির্মাণ অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। । উৎপাদন  কার্যক্রম পরিচালিত  ট্যানারীর তরল বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে সিইটিপিতে নেয়া হচ্ছে, কিন্তু কঠিন বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে, প্রকল্প কার্যালয়ের উত্তরের রাস্তার দুপাশে এবং আবাদি জমিতে ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদনে যেতে ব্যর্থ শিল্প মালিকদের প্লট বাতিল করা, গ্যাস, পানি, বিদ্যুত বিছিন্নসহ হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করা, বিদ্যমান আইনে সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। সেই সাথে সাভারে নদী ও আবাদি জমিতে দূষণ শুরুর দায়ে দায়ী ট্যানারী মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উক্ত দাবী জানানো হয়। 

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। উপস্থিত ছিলেন পবার সহ-সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম, স্থপতি শাহীন আজিজ, মো: সেলিম, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, এডভোকেট নিরুপমা, মোস্তারি বেগম প্রমুখ। 

মূল প্রবন্ধে বলা হয় - হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো সাভারস্থ চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরের জন্য একাধিকবার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০০১ সালে মহামান্য হাইকোর্ট এক রায়ে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারী সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এরপর ২০০৯ সালের ২৩ জুন আরেক আদেশে ট্যানারী সরানোর জন্য ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। পরবর্তীতে সরকার পক্ষের আবেদনে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়ানোর পরও ট্যানারী স্থানান্তরে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারী স্থানান্তর না করা পর্যন্ত ১৫৪টি ট্যানারীর মালিকের প্রত্যেককে পরিবেশ দূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। ১৬ জুন ২০১৬ তারিখে মহামান্য হাইকোর্ট এক আদেশে হাজারীবাগের ট্যানারী বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় যাওয়ায় প্রতিদিন পরিবেশের কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা নিরুপণ করে ১৭ জুলাই ২০১৬ তারিখের মধ্যে পরিবেশ সচিবকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ প্রদান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১ জুলাই ২০১৬ বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০১৬ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেন যে, হাজারীবাগ থেকে সাভারে যেতে ট্যানারী মালিকরা নানা ছল-চাতুরী এবং অযথা দেরি করছেন। এটা ঠিক না। তাদের উচিত দ্রুত তাদের ট্যানারী সাভারে স্থানান্তর করা।

হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহের দূষণের ভয়াবহতা এবং সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারীগুলো স্থানান্তর ও সিইটিপি নির্মাণ-এর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পবা আগষ্ট ২০১৪ থেকে হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ সাভারস্থ চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে মনিটরিং করছে। একই সাথে হাজারীবাগ এলাকা ও বুড়িগঙ্গা নদী এবং ধলেশ্বরী নদীর ঢাকা চামড়া শিল্পনগরী এলাকার দূষণ সরেজমিন পরিদর্শন এবং বর্জ্য ও নদীর পানির দ্রবিভ’ত অক্সিজেন, পিএইচ পরীক্ষা করে যাচ্ছে। পবার সরেজমিন পরিদর্শন ও জরীপে প্রাপ্ত ফলাফল ভিত্তিতে সাতটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ১৪ মার্চ ২০১৫, ১৭ মে ২০১৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬, ৪ এপ্রিল ২০১৬ এবং ২৫ মে ২০১৬ তারিখে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। পবার একটি প্রতিনিধি দল গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে ট্যানারী স্থানান্তর কার্যক্রমের সর্বশেষ অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করে। পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, সিইটিপির দুটি মডিউলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সিইটিপির বাকি দুটি মডিউলের নির্মাণ কাজ ধীর গতিতে চলছে। ট্যানারীর বর্জ্য তিনটি ইপিএস (বর্জ্য পাম্পিং ষ্টেশন) এর মাধ্যমে সিইপিটিতে যাবে। ২ নং ইপিএস এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, ১ নং ইপিএস এর নির্মাণ কাজ চলছে এবং ৩ নং ইপিএস এর নির্মাণ কাজ অত্যন্ত ধীর গতি চলছে। বর্জ্য ইপিএস হয়ে সিইটিপিতে যাওয়ার পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। ৩টি ক্রোম রিকভারি ইউনিটের মধ্যে ১টির নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন এবং বাকি ২টির নির্মাণ কাজ অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে।

৩৯টি ট্যানারীতে ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করা বা স্থাপনের কাজ চলছে। ৬টি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু হয়েছে। সিসিআরইউ চালু  না হওয়ায় ক্রোমিয়াম মিশ্রিত বর্জ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইপিএস-১ সম্পন্ন না হওয়ায় পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য ইপিএস-২ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সাবষ্টেশন নির্মাণ এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে আবেদন করা (১৪২টি ট্যানারী আবেদন করেছে)। ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের অনুক’লে ডিমান্ড নোট ইস্যুর পর ২৬টি প্রয়োজনীয় অর্থ জমা দিয়েছে। ১৭টি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সাবষ্টেশন নির্মাণ করা বা নির্মাণের কাজ চলছে। উৎপাদন  কার্যক্রম পরিচালিত  ট্যানারীর তরল বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে সিইটিপিতে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু কঠিন বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে, প্রকল্প কার্যালয়ের উত্তরের রাস্তার দুপাশে এবং আবাদি জমিতে ফেলা হচ্ছে। ফলে এলাকার পরিবেশ এবং ধলেশ্বরী নদী  দূষণ ও ভরাট হচ্ছে। কঠিন বর্জ্য সৃষ্ট দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।  

সিইটিপির দুটি মডিউলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও বর্জ্যরে অভাবে তা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। সাভারে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিল্প ভবন নির্মাণ অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। যে ৩৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ট্যানিং ড্রাম স্থাপনের কাজ চলছে তার প্রায় সবগুলোতেই বিদ্যুৎ সাবষ্টেশন নির্মাণ করা হয়নি বা নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়নি। ফলে সব কিছু প্রস্তুত হলেও বিদ্যুতের অভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব হবে না। 

ট্যানারি স্থানান্তরের দীর্ঘসূত্রীতার প্রধান অন্তরায় ট্যানারি মালিকদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দেয়া, অন্য দিকে নিজেদের ব্যক্তিগত মুনাফাকে প্রাধান্য দেয়া এবং সরকারি সিদ্ধান্ত ও মহামান্য আদালতের নির্দেশ গ্রাহ্য না করা। আমরা বিশ্বাস করতে চাই ট্যানারী মালিকরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করবেন। 

করণীয়
*  হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ সাভারস্থ চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরের জন্য একাধিকবার সময়সীমা বেঁধে দেয়ার পরও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, যন্ত্রপাতি স্থানাস্তর ও উৎপাদন শুরু করতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে সাভারের প্লট বাতিল করা এবং গ্যাস, পানি, বিদ্যুত সংযোগ বিছিন্নসহ হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো বন্ধ করা।
*    হাজারীবাগের ট্যানারীগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
*   পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো থেকে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৬৫০ কোটি টাকা আদায় করা। 
*   ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখের সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী বিএফএলএলএফইএ ও বিটিএ থেকে সিইটিপি নির্মাণে বিনিয়োগকৃত অর্থ আদায় করা।
*   সিইটিপি বান্তবায়নসহ প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম নির্দিষ্ট সময়ে সমাপ্ত না হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।