দূর্যোগ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমুহের দায়িত্ব সুস্পষ্টকরণ ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা জরুরী
অপরিকল্পিত নগরায়ন আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ঢাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে চলেছে। সাভারের রানা প্লাজা ধ্বস এর পূর্ব সংকেত মাত্র। সাভার ট্র্যাজেডির কারণ হিসেবে দুটি দিক চিহ্নিত করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে নির্মাণগত অন্যটি এর ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনাগত ত্র“টির দিক। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের দায়িত্ব সুস্পষ্টকরণ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে আমাদেরকে সাভারের মতো আরও ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হতে হবে। রানা প্লাজা পরিদর্শন ও ঢাকার নগরায়নের বর্তমান চিত্র বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে আজ ১১ মে ২০১৩, শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ছোট রুমে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আয়োজিত “সাভার ট্র্যাজেডির দায় এবং ভবিষ্যৎ করণীয়” বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশের এক সংবাদ সম্মেলন থেকে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।  
 
সাভার দূর্ঘটনার প্রথম থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উপস্থিত থাকা পবার সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক বক্তব্য তুলে ধরেন। পবার নির্বাহী কমিটির সদস্য এ কে এম সেরাজুল ইসলামের সভাপতিত্ত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। সঞ্চালনা করেন পবার সম্পাদক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পীস মুভমেন্ট বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক কামাল আতাউর, পীসের মহাসচিব ইফমা হুসাইন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত। 
 
প্রতিবেদনে সাভার ট্র্যাজেডির নিন্মলিখিত কারণসমূহ উল্লেখ করা হয়-                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                        
ভবনটি একটি অংশ জলাশয় ভরাট করা মাটির ওপর, যথাযথ নকশা না মেনে নির্মাণ করা, নিম্নমানের  নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ অনুপাত অনুসরণ না করা, দুর্বল কাঠামো, অনুমোদনের অতিরিক্ত তলা নির্মাণ, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও পেশাজীবিদের তদারকির অভাব, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, ভবনটি নির্মাণ ও ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করা, ভবন ব্যবহারের ধরণ পরিবর্তন করে গার্মেন্টের মতো যন্ত্র ও কর্মীবহুল শিল্পকারখানা স্থাপন। 
 
পবা থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশসমূহ করা হয়-
১. ভবন নির্মাণ-প্রক্রিয়াকে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা। সাভার ট্র্যাজেডিকে একটি অশনিসংকেত বিবেচনা করে জরুরীভিত্তিতে সর্বোচ্চ সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেয়া।
২. জীবিত উদ্ধারকৃত আহতদের কারো হাত নেই, কারো পা নেই। তাদের চিকিৎসা, অসহায় পরিবারগুলোকে আহত ব্যক্তিদের ভবিষ্যতের আয়ের হিসাব বিবেচনায় ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিবারে কর্মক্ষম অন্য সদস্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। নিহত শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে নিহত ব্যক্তিদের ভবিষ্যতের আয়ের হিসাব বিবেচনায় ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং পরিবারে কর্মক্ষম অন্য সদস্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জীবিত উদ্ধারকৃত শ্রমিকদের ট্রমাজনিত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। হতাহতের পরিবারগুলো যেন কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, শিশুরা যাতে শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ে, পরিবারগুলোর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং ভবিষ্যতের দিকে ভীতি নিয়ে না তাকাতে হয় এসব বিষয়ে বিজিএমইএ, মালিক ও সরকারকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
৩. জীবিত উদ্ধারকৃত এবং উদ্ধারকর্মীদের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা। 
৪. সাভার  ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী  ব্যক্তিদের যথোপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে ন্যায় বিচারের নতুন সংস্কৃতি তৈরী করা। 
৫. শ্র্র্রম আইন ২০০৬ বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে সংশোধন করা। কর্মক্ষেত্রের সামগ্রিক নিরাপত্তা, আইন অমান্য করা বা অবহেলার কারণে দুর্ঘটনার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিধান এই সংশোধনীতে সন্নিবেশিত করা দরকার।
৬. ভূমিকম্প ও অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনায় পৃথক মহড়া দিতে হবে। বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষিতদের সমন্বয়ে একটি পৃথক ভবন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন অত্যন্ত জরুরি। ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার পর তা যথাযথভাবে তদারকি করতে হবে। ভবণ নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
৭. উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা উপযোগী প্রশস্থ রাস্তা সম্বলিত নকশার অনুমোদন, দুর্ঘটনা কবলিত ভবনের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ যাতে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় সে ব্যবস্থা গড়ে তোলা। শিল্প ভবনের নকশায় প্রশস্ত সিঁড়ি, শ্রমিকদের সহজে চলাচলের ব্যবস্থা, বিপদের সময়ে দ্রুত নেমে আসার জন্য বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। কারখানা চালু অবস্থায় সিড়িগুলো তালাবদ্ধ না রাখা।
৮. উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্ল্যাব ছিদ্র করার ড্রিল, রড কাটার ব্লেড, হেভি ডিউটি জেনারেটর, ক্রেন, ক্রাশার, তাৎক্ষণিক স্থাপনযোগ্য ১০০ শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল, রিমোট সেনসিং ডিভাইস, কংক্রিটের স্তুপের মধ্যে উদ্ধার কাজের জন্য লাইফ লোকেটর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা এবং যন্ত্রপাতিগুেলা ফায়ার সার্ভিসকে দেয়া। এছাড়াও যে সকল সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় এসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তাদের তালিকা প্রণয়ন, এসকল সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও অপারেটরদের ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর এবং ভবনের নকশা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসে সংরক্ষণ করা, যাতে দুর্ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকে অবহিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
৯. উদ্ধার কাজে অংশ গ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবীদের তালিকা প্রণয়ন করা এবং এসব স্বেচ্ছাসেবীসহ উদ্ধারকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট, ডাক্তার, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সশস্র বাহিনী, পেশাজীবি ( বিদ্যুৎ, গ্যাস, নির্মাণ সংক্রান্ত) সমন্বয়ে জাতীয় উদ্ধার দল গঠন করা এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস এবং সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর-এর অনুক’লে বাজেটে থোক বরাদ্দ রাখা। দুর্ঘটনাজনিত তাৎক্ষণিক ব্যয় নির্বাহের জন্য সংস্থাগুলোর প্রধান প্রত্যেকে অন্ততঃ ১ (এক) কোটি টাকা নগদ ব্যয় করতে পারবেন এ মর্মে পিপিআর সংশোধন করা।
১০. শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করার কথা। এর  মধ্যে ১ শতাংশ সরকার গঠিত কল্যাণ তহবিলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এফবিসিসিআইকেও এ বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
১১. ড্যাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে কোনো অস্পষ্টতা জরুরীভিত্তিকে নিরসন করা। ভবন নির্মাণের শুরু থেকে ব্যবহার পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে আইনকানুন মেনে চলতে সংশ্লিষ্ট সকলকে বাধ্য করা। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোর্ড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণে ভবন নির্মাণ এবং নির্মাণ শেষে ভবনটির ব্যবহার উপযোগীতার  বিষয়ে রাজউককে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ভবন নির্মাণের আগে যে প্রতিষ্ঠানগুলো মাটি পরিক্ষা করে, তাদেরকে একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অধীন আনা জরুরী। 
১২. আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পভবন, শপিং কমপ্লেক্স বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ জরুরীভিত্তিতে সংশোধন করা। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর তফসিল-১ এর (গ) কমলা-খ শ্রেণী শিরোনামাধীন ক্রমিক নম্বর ৬০ এর বিপরীতে উল্লেখিত “পোষাক ও সুয়েটার প্র¯তুত।” বিধিমালায় পুনর্বহাল করা।
১৩. তৈরী পোশাক খাতের জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ/বোর্ড গঠন করা। 
১৪. রাজউকের প্রকল্প নির্ভরতা কমিয়ে উন্নয়ন সমন্বয়ে ভূমিকা রাখা।