জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরী

শুষ্ক মৌসুম আসতে না আসতেই মহানগরী ঢাকায় ধুলা দূষণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ধুলা দূষণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ধুলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। এ ছাড়াও ধূলা দূষণের ফলে বাসা বাড়িসহ দোকানের মূল্যবান জিনিস দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং এসব পরিষ্কার করতে প্রতিদিনকার মূল্যবান সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে হয়। ফলে ধুলা দূষণে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হচ্ছে তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য,পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী।
আজ ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ইং বুধবার, সকাল ১১ টায়, শাহবাগস্থ ঢাবি’র চারুকলা অনুষদের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে “ধুলা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই” দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উল্লেখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে এবং পবা’র প্রোগ্রাম অফিসার তানভির মাসুম এর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন,পবা’র সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য শামীম খান টিটো, সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, স্থপতি শাহীন আজিজ, সুবন্ধন সামাজিক কল্যাণ-এর সভাপতি হাবিবুর রহমান, মার্শাল আর্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আতিক মোরশেদ, মর্ডান ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানত, ডাব্লিউবিবিট্রাস্ট এর প্রকল্প কর্মকর্তা আতিকুর রহমান, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুর ইসলাম টুরবুস, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ- এর সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পী প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ধুলা দূষণের ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধুলা দূষণের ফলে শারিরীক পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য রক্ষার জন্যও অধিক সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। জামা-কাপড় ধোঁয়া, বাসাবাড়ি ধোঁয়া-মোছার জন্য অতিরিক্ত পানি ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হয়। আর এসব পরিষ্কারক দ্রব্যের পরবর্তী গন্তব্য হয় ড্রেনের মাধ্যমে আমাদের নদী, লেক, জলাধারসমূহে। যা জলজ প্রাণীসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্রের জন্যও ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পানি, বিদ্যুৎ ও ডিটারজেন ব্যবহারের ফলে পারিবারিকভাবে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধূলা দূষণের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৪,০০০ থেকে ১০,০০০ ব্যয় করতে হচ্ছে। 
ঢাকা শহরের চারপাশের ইটভাঁটার দূষণ, অধিক যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া, অনিয়মিত রাস্তাঘাট পরিষ্কার, অপরিকল্পিত রাস্তা খোড়াখুড়ি ও মেরামত, দালান-কোঠা বা অন্য কোন অবকাঠামো তৈরীর সময় নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় রাখা, গৃহস্থালিসহ বিভিন্নভাবে উৎপন্ন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাসহ নানাভাবে প্রতিদিন ধূলা উৎপন্ন হচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবানুমিশ্রিত ধুলা ফুসফুসে প্রবেশ করে সর্দি, কাশি, ফুসফুস ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানী, যক্ষ্মা, এলার্জি, চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে ধুলা দূষণের কারণে শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। বর্তমানে শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশ শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ ভয়াবহ ধুলা দূষণের শিকার।
বক্তারা জানান-ধূলা দূষণ রোধে নিয়মিত রাস্তা পরিস্কার করতে হবে। পরিসেবার সংযোগ মেরামত, বৃদ্ধি ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খননে সৃষ্ট মাটি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলতে হবে। দালান-কোঠা বা অন্য কোন অবকাঠামো তৈরীর সময় নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় রাখা যাবে না। এমন কোন সামগ্রী যা থেকে ধুলা সৃষ্টি হতে পারে তা বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তার পাশের ড্রেন নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে। ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় প্রবেশ করা যানবাহনগুলোর যথাযথভাবে পরিস্কার করতে হবে। ধুলা দূষণ যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও তার যথাযথ বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি ধূলা দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা তৈরীর জন্য সরকারী, বেসরকারী সংগঠন ও সচেতন মহলকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বায়ু ও ধুলা দূষণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরীসহ নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরকে বেইজিং, দিল্লী, তেহরান, প্যারিস-এর মতো ধূলা দূষণজনিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।
সুপারিশ
১। যানবাহন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত মানের জ্বালানী আমদানি ও ব্যবহার করা;
২। ইট প্রস্তুতে আধুনিক প্রযুক্তি ও লো সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার করা;
৩। পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সকল পরিসেবা কার্যক্রমের জন্য রাস্তা একবার খনন করা। পরিসেবার সম্প্রসারণ, সংযোগ, মেরামত ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খননকৃত মাটি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা;
৪। রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা;
৫। ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা;
৬। ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া;
৭। নালা-নর্দমা পরিস্কার করার পর আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে না রাখা এবং দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেয়া; 
৮। সকল আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে যানবাহন থেকে আর্বজনা রাস্তায় ছড়িয়ে না পড়ে; 
৯। কলকারখানায় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
১০। পার্ক, লেক, জলাধার সংরক্ষণ করা, নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করা এবং অধিক পরিমাণে গাছ লাগানো;
১১। ধুলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা;
১২। ধূলা দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা।