মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার চালিত গাড়ি একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণজনিত দূর্ঘটনা রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ চাই
মেয়াদোত্তীর্ণ, ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে প্রায়ই বিভিন্ন দূর্ঘটায় মানুষের প্রাণহানী ঘটছে। নিম্নমানের কম পুরুত্ববিশিষ্ট সিলিন্ডারের ব্যবহারও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফেরণের অন্যতম একটি কারণ। একই সঙ্গে পুনব্যবহৃত পুরোনো অচল সিলিন্ডার, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার এতটাই ঝুঁকিপূর্ন যা শক্তিশালী বোমার সাথে তুলনাযোগ্য। সিলিন্ডার বিস্ফোরণজনিত দূর্ঘটনা রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। “গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ-বিপদসংকুল জনজীবন ও পরিবেশ” রক্ষার্থে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর উদ্দ্যোগে ১০ ডিসেম্বর ২০১৬, শনিবার, সকাল ১১টায় পবা মিলনায়তনে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ দাবী করা হয়।
 
পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, নাগরিক পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, পবা’র সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, মর্ডান ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানত, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি ও পবা’র সদস্য হাজী শেখ আনসার আলী প্রমুখ। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, সিলিন্ডারের প্রায় ৮৮ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে সিএনজিচালিত এ সকল যানবাহনে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যখন-তখন দুর্ঘটনা ঘটছে। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার এতোটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যে এগুলোকে ‘শক্তিশালী বোমা’র সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে প্রায়ই ঘটছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা। দেশে গত পাচ বছরে ৩০০টির বেশি সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। দীর্ঘদিনের পুরাতন সিলিন্ডার ব্যবহার করায় গাড়ি চালক ও ব্যবহারকারী নিজেই জানেন না তার গাড়িটি বিপজ্জনক বোমা হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়েও কয়েকটি গাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। 
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, প্রতিটি গাড়ির সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা ও সিএনজি সিস্টেম পরীক্ষা এবং সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বার্ষিক নিরাপত্তা জরিপ আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হলেও তা প্রতিপালিত হচ্ছে না। এছাড়া সাড়ে চার লাখের বেশি সিএনজি সিলিন্ডারের আয়ুস্কালের ক্ষেত্রেও  আইন অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে ত্রুটিযুক্ত সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। একটি সিএনজি সিলিন্ডারের মেয়াদ ৫ বছর। এরপর সিলিন্ডারটি রিটেস্টিং করা হয়। রিটেস্টিংয়ে সিলিন্ডারটি গাড়ির জন্য উপযুক্ত হলে আরও ৩ বছর ব্যবহার করা হয়। জ্বালানী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৫৪ হাজার সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিং বা পুনরায় পরীক্ষা  করা হয়েছে। যা মোট সিলিন্ডারের মাত্র ১২%। অর্থাৎ ৮৮% সিলিন্ডার  রিটেস্টিং করা হয়নি। সম্প্রতি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষায় সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের বিধান যুক্ত করার পরও রিটেস্টিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
 
সিএনজি সিলিন্ডারে প্রতি বর্গইঞ্চিতে তিন হাজার পাউন্ড চাপে গ্যাস দেয়া হয় এবং গ্যাস পূর্ণ করার সময় সিলিন্ডার ও গ্যাস  উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে। সিলিন্ডার যথাযথ না হলে বড় ধরনের অঘটন ও প্রাণহানি ঘটতে পারে। বাস-ট্রাকে ছয় থেকে আটটি সিলিন্ডার থাকে বিধায় বিস্ফোরণের ঝুঁকিও বেশি। 
 
ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নে শিথিলতার সুযোগে গাড়ির মালিকরা  মেয়াদোত্তীর্ণ  সিএনজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। সেই সঙ্গে গাড়ির ফিটনেস সনদ প্রদানে বিআরটিএ’র (বাংলাদেশ রোডট্রান্সপোর্ট অথরিটি) উদাসীনতাও দায়ী। গাড়িতে সিলিন্ডার ব্যবহারকারীই প্রথমত দুর্ঘটনার শিকার হন। সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুর্ঘটনার জন্য তাদের অসচেতনতাই বেশি দায়ী । এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল মহল হতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি একান্ত  আবশ্যক। সিএনজির চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েকটি অসাধু চক্রের হাতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অননুমোদিত সিএনজি কনভারসন  প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে রয়েছে অদক্ষ মেকানিকদের পাল্লায় পড়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা। আর এসব জায়গা থেকে সেবা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে সাধারণ মানুষ। যার খেসারত দিতে হচ্ছে জীবনের মূল্য দিয়ে। সম্প্রতি কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা  যেন সেই অসচেতনতা ও অসাধুতার প্রতিচ্ছবি।
 
সিএনজিতে রূপান্তরের সময় অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে রূপান্তরকারী প্রতিষ্ঠানটি অবশ্যই সরকার অনুমোদিত। প্রতিটি সিলিন্ডারের সঙ্গেই ওই সিলিন্ডারের নিজস্ব টেস্ট রিপোর্ট থাকে, যেটা কেনার সময় সবার উচিত সিলিন্ডারের নম্বরের সঙ্গে মিলিয়ে ওই টেস্ট রিপোর্ট সংগ্রহ করা এবং সব তথ্য মিলিয়ে দেখা। যেকোনো সিলিন্ডার চালু হওয়ার পর ন্যূনতম পাঁচ বছর পরপর একবার করে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার বিধান রয়েছে। যেটা আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেনে চলা হয়না। সে ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে তা পরীক্ষায় বের হয়ে আসে এবং দীর্ঘমেয়াদে ওই সিলিন্ডার ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এই পরীক্ষা সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে করানো এবং সিলিন্ডার সংশ্লিষ্ট কোনো সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই দক্ষ মেকানিকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
 
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে চট্রগ্রামে এলপি জি প্লান্ট স্থাপন করা হয়। এ প্লান্টে  গত ৫ বছরে গড়ে ১৩,০০০ মে. টন এবং সিলেটের কৈলাসটিলা প্লান্টে ৭,০০০ মে. টন এলপিজি সিলিন্ডারজাত করা হয়। যা দেশের বর্তমান চাহিদার ১৫-২০%। দেশে বর্তমানে এলপিজির চাহিদা ৩ লাখ টনের বেশি। ৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ১৫ লাখের বেশি সিলিন্ডারের মাধ্যমে ৮০ হাজার টন এবং বিপিসি ৫ লাখ সিলিন্ডারের মাধ্যমে ২০ হাজার টন সরবরাহ করছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এলপিজি সিলিন্ডারের আয়ুস্কাল ১৫ বছর। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার প্রতিস্থাপন করা আবশ্যক। এলপি গ্যাস লিমিটেডের আমদানিকৃত ৫ লাখ সিলিন্ডারের ২ লাখেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ, ৩ লাখ খুব পুরানো এবং ৮০% অনিরাপদ। সরকারের এলপিজি নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা না থাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার প্রতিস্থাপন অনুশীলন করা হচ্ছে না। এছাড়া আমদানিকৃত সিলিন্ডার যথাযথভাবে পরীক্ষা করা হয় না বিধায় সরবরাহকারীর পক্ষে নি¤œমানের সিলিন্ডার সরবরাহ করা সহজ হচ্ছে। ব্যবহারকারীর অসচেতনতা বিষয়টি আরো ভয়াবহ করে তুলছে।
 
সুপারিশ
০১। সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বার্ষিক নিরাপত্তা জরিপ করা।
০২। সিএনজি সিলিন্ডারের আয়ুস্কাল নির্ধারণ করা।
০৩। প্রতিটি গাড়ির সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা ও সিএনজি সিস্টেম পরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি যানবাহন মালিকদের বাধ্য করা। বিশেষ করে বাস-ট্রাকের মালিকদের।
০৪। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষায় সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের বিধান বিআরটিএ কর্তৃক যথাযথভাবে পালন করা।
০৫। গাড়ির মালিকদের  মেয়াদোত্তীর্ণ  সিএনজি সিলিন্ডার ব্যবহার  বন্ধে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। 
০৬। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার এতোটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে তা ‘শক্তিশালী বোমা’র সঙ্গে তুলনাযোগ্য। এ বিষয়ে আরপিজিসিএল কর্তৃক ব্যাপক প্রচারণা চালানো।
০৭। সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুর্ঘটনার জন্য গাড়ি চালক ও ব্যবহারকারী, সিএনজি ফিলিং ষ্টেশনের মালিক ও কর্মচারিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের অসচেতনতাই বেশি দায়ী। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল মহল হতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি একান্ত  আবশ্যক।
০৮। রূপান্তর কাজে নিয়োজিত কারিগর বা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
০৯। গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার সময় অবশ্যই গাড়ি থেকে নেমে নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষা করা।
১০। আরপিজিসিএল এবংএলপি গ্যাস লিমিটেড কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।
১১। এলপিজি নীতিমালা ও গাইডলাইন প্রণয়ন করা।
১২। আমদানিকৃত সিএনজি ও এলপিজি সিলিন্ডার যথাযথভাবে পরীক্ষা করা।
১৩। মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি ও এলপিজি সিলিন্ডার প্রতিস্থাপন করা।
১৪। বৃহত্তর জেলাসমূহে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অফিস স্থাপন এবং লোকবল বৃদ্ধি বরা।