জাহাজ ভাঙ্গা, রাসায়নিক ও বর্জ্য দূষণ রোগ, মৃত্যু বৃদ্ধি করছে

জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রম, রাসায়নিক ও বর্জ্য দূষণ পরিবেশ ধ্বংশের পাশাপাশি রোগ ও মৃত্যু বৃদ্ধি করছে। মানুষের জন্য বানিজ্য, বানিজ্যের জন্য মানুষ নয়। মানুষের জীবনকে হুমকিতে রেখে, বানিজ্যকে প্রধান্য দেয়া অসংবিধানিক, অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক। মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও দেশের অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে জাহাজ ভাঙ্গা, দাহ্য রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য দূষণ রোধে রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আজ ১৩ অক্টোবর সকাল ১১.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলন (পবা) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে “জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রম, আবাসিক এলাকায রাসায়নিক মজুদ:আর কত অকারণ মৃত্যু” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তরা উপরোক্ত দাবী জানান।

বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এম মুহিবুর রহমানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবু জাফর মাহমুদ, পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, ড. হোসেন শাহরিয়ার, নবাব কাটরা সমাজ কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাজী মো: শহীদ, কবি লিলি হক, পাখি বিশেষজ্ঞ যশোধন প্রামাণিক, ভাসানী ন্যাপের প্রেসিডেন্ট মোস্তাক হোসেন ভাসানী প্রমুখ। জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রমের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পবা’র সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী এবং আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক মজুদ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নীতি বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম।

বক্তারা বলেন, জাহাজ ভাঙ্গাকে শিল্প হিসেবে দেখানো হলেও এটি শিল্প নয়। কারণ শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিল্প উপকরণ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু জাহাজ ভাঙ্গায় রয়েছে অভাবী মানুষের ঝুঁকিপুর্ণ শ্রম। সরকারের কাছে অপ-যুক্তি দিয়ে এই জাহাজভাঙ্গা কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের জন্য কয়েক হাজার অভাবী মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে। এ কার্যক্রমে সমুদ্র উপক’লের পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়ের পাশাপাশি রাসায়নিকের বিষক্রিয়ায় তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করছে অনন্যোয় শ্রমিকসহ উপক’লের এক বিরাট জনগোষ্ঠী। মুনাফালোভী জাহাজভাঙ্গা শিল্পের মালিকরা জীবন ও পরিবেশের এ মারাত্মক বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে মরিয়া হয়ে উঠেছে এর প্রসারে। এ কার্যক্রমে বিভিন্ন রকম দূর্ঘটনায় এ যাবৎ প্রায় ৩৪ জন মৃত্যু বরণ করেছে। এছাড়া গত ১৮ মাসে এইসব বিষাক্ত জাহাজগুলি ভাঙ্গার সময় ১৬ বার দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন শ্রমিকরা। সর্বশেষ দূর্ঘটনা ঘটে জাহাজ ভাঙ্গা ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজের প্লে¬ট চাপা পড়ে কমপক্ষে ৩ জন শ্রমিক নিহত হন, আহত হয় বেশ কয়েকজন। মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানোর জন্য দূর্ঘটনা এলাকা থেকে অনেকের লাশও উদ্ধার করা হয় না। 

এছাড়া রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ  আবসিক এলাকার দোকানে, গুদামে এবং বিভিন্ন শিল্পে যথাযথ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাসায়নিক মজুদ করে রাখা হয়েছে। ফলে রাসায়নিক বিস্ফোরণে কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ, অসুস্থ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে অনেকে। যেমন ৩ আগস্ট ২০০৮ তারিখে আগাসাদেক রোড়ে, ২০১০ এর ফেব্রুয়ারীতে মকিম বাজারে, মার্চে হাজারীবাগের এপেক্স ট্যানারীতে, ০৩ জুন ২০১০ নিমতলীতে এবং ০৬ অক্টোবর ২০১০ যাত্রাবাড়ীতে  দাহ্য রাসায়নিকের বিস্ফোরণে বিপুল প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া প্রায়ই রাসায়নিক বিস্ফোরণে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং অনেকের অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে আমাদের আন্দোলন ও মিড়িয়ার ব্যাপক প্রচারের প্রেক্ষিতে এই প্রথম সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দাহ্য রাসায়নিক আবাসিক এলাকা থেকে অপসারণে সরকার কর্তৃক গঠিত টাস্কফোর্স ও বিশেষ আদালত বিক্ষিপ্ত অভিযান চালালেও বদলায়নি চিত্র। সরকারকে কোন ধরনের অজুহাত ব্যতীত এ সকল বিষয়ের সমাধানে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বক্তারা বলেন, পুরাতন ঢাকা নিমতলীর রাসায়নিক দূঘর্টনার কান্না থামেনি, তারপর ঘটেছে যাত্রাবাড়ীতে দূঘর্টনা। এর অর্থ দাঁড়ায় এ বিষয়ে প্রশাসনের উদ্যোগ যথার্থ নয়। পুরাতন ঢাকার গোডাউনগুলো সরানোর নির্দেশ দেয়া হলেও, তা এখনো সরানো হয়নি। কোথায় গোডাউনগুলো সরানো হবে এ বিষয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যরত ব্যক্তিরা যখনই পরিবেশ দুষণকারী ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, তাদের নানাভাবে নাজেহাল করা হয়। ব্যবসায়ীরা লাভের ভাগ নিলেনও, দুষণ নিয়ন্ত্রণের খরচের দায় চাপানো হয় সরকারের উপর। সরকার জনগনের অর্থ ব্যয় করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। সরকারের জনগনের স্বার্থ দেখতে হবে। জনগনের স্বাস্থ্য, অর্থ, পরিবেশ রক্ষা সরকারের প্রধান ও মূল দায়িত্ব। পরিবেশ দূষণকারী ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের হাত হতে জনগনকে রক্ষা করা সরকারের মূল দায়িত্ব। 

গোলটেবিল বৈঠক থেকে নিন্মোক্ত দাবীসমূহ জানানো হয়-

১. বিষাক্ত বর্জ্যযুক্ত বিদেশী জাহাজের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশরোধে এবং শ্রমিক স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষায় জাহাজভাঙ্গা শিল্প বন্ধ বা এর ‘নিরাপদ বিকল্প’ প্রতিষ্ঠা ।
২. “ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে আনিত প্রতিটি জাহাজ অবশ্যই ‘বিষাক্ত ও বর্জ্যমুক্ত’ এ মর্মে রপ্তানিকারক দেশ বা সেদেশ কর্তৃক অনুমোদিত সংস্থার প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে আসবে হাইকোর্টের এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন।
৩. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইন অমান্যকারী অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে বিগত সময়ে বিভিন্ন শিপব্রেকিং ইয়ার্র্ডে সংঘটিত ঘটনার দ্রুত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা হোক। 
৪. আদালতে বিচারাধীন বিষয়কে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ও কর্মীদের বিরুদ্ধে জাহাজভাঙ্গা শিল্প মালিক কর্তৃক দায়েরকৃত মানহানির মামলা প্রত্যাহারের দাবি।
৫. অবিলম্বে রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন, গুদামজাতকরণ ও সরবরাহ এর জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হোক;
৬. আবাসিক রাসায়নিক দ্রব্যাদির উৎপাদন, বিপনন ও গুদামজাতকরণ সম্পূর্ন নিষিদ্ধ করা;
৭. আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যাদির কারখানা, গুদাম ও দোকান অবিলম্বে উচ্ছেদ করা; 
৮. যে সমস্ত কর্তৃপক্ষের/ব্যক্তির অবহেলার কারণে পুরনো ঢাকায় এই রকম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা;
৯. অনতিবিলম্বে প্রত্যেকটি রাসয়নিক কারখানায় এবং গুদামে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা  বাস্তবায়ন করা; 
১০. রাসায়নিক কারখানায় কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রবাদি ও পরিচালনা ধারণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান।