সিইটিপির সাথে সমন্বয় করতে মালিকদের দ্রুততম সময়ে ট্যানারী স্থানান্তরে বাধ্য করতে হবে

বুড়িগঙ্গা নদীসহ মহানগরীর সার্বিক পরিবেশ রক্ষায় হাজারীবাগের ট্যানারী সাভারের শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও দীর্ঘদিনেও তার বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সিইটিপির ফাউন্ডেশনের ৭৫% কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে যা সিইটিপির ২৫%। অন্যদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ¯া’নান্তর কার্যক্রম অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৫টি পাইলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ১৯টি সীমানা দেয়াল, গার্ড রুম নির্মাণ করছে এবং বাকি ১২১টি কোন কার্যক্রম শুরু করেনি। অথচ সিইটিপি নির্মাণ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ একই সঙ্গে সমান্তরালে না চললে একটির জন্য অন্যটিকে বসে থাকতে হবে। তাই সরকারের প্রয়োজন শিল্প মালিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করা, প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে তারা দ্রুততম সময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উৎপাদনে যায়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি সাভারের শিল্পনগরীতে হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ স্থানান্তরের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন, জরিপ ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন প্রকাশের লক্ষ্যে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, শনিবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়। 

সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়- হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অন্যতম কারণ।  মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ বুড়িগঙ্গা আজ একটি মৃত নদী। হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহ দৈনিক ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য বিপদ ডেকে আনছে । এছাড়াও  প্রতিদিন আনুমানিক ১০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য তৈরী হচ্ছে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকালে এর পরিমাণ প্রায় ২০০ মেট্রিক টন। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ফরমিক এসিড, বি¬চ, ডাই, তেল,  চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত অনেক ভারী ধাতু, চুন, পশুর মাংস, দ্রবীভূত চুল, চর্বি ইত্যাদি। এসব বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি পানি, বায়ু, মাটি দূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। 

মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ, পরিবেশবাদী সংগঠন ও জনগণের অব্যাহত আন্দোলন এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় ও কার্যকর ভ’মিকার ফলশ্রুতিতে ২০০২ সালের ২৭ জানুয়ারী সরকার হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ট্যানারি শিল্পসমূহকে ঢাকা জেলার সাভার ও কেরানীগঞ্জ উপজেলায় স্থানাšতরের কার্যক্রম গ্রহণ করে। এ কার্যক্রমের আওতায় বিসিক কর্তৃক পূর্বে অধিগ্রহণকৃত ১৭.৩০ একরসহ মোট ২০০ একর জমিতে ২০৫টি প্ল¬ট (প্ল¬টের আয়তন ৮০০০০, ৪০০০০, ২০০০০ এবং ১০০০০ বর্গফুট) তৈরিসহ দৈনিক ২০,০০০ ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ¯হাপনের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলা হবে। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ১৭৫.৭৫ কোটি টাকা (জিওবি ৯৪.০০ কোটি টাকায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনা ব্যয় এবং প্রকল্প সাহায্য ৮১.৭০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৭.০০ কোটি টাকায় ঈঊঞচ নির্মাণ করা ও ৪.৭৫ কোটি টাকায় ঝষঁফমব/ডধংঃধমব উঁসঢ়রহম ণধৎফ নির্মাণ করা)। এ কার্যক্রম বা¯তবায়নের সময়কাল ছিল জানুয়ারী ২০০৩ হতে ডিসেম্বর ২০০৫। 

পরবর্তীতে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর একনেক সভায় ৫৪৫.৩৬ কোটি টাকায় জানুয়ারী ২০০৩ - জুন ২০১০ মেয়াদে আরডিপিপি অনুমোদিত হয় (১৪৮.৬৬ কোটি টাকায় জমি উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণ এবং ৩৯৬.৭০ কোটি টাকায় সিইটিপি ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ)। এ সময়সীমা ২০১২ সালের জুন, পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের ২০১৩ সালের ২৯ মে তারিখে ডিপিপির উপর পিইসি সভায় ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত এবং ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় ৮২৭.৯৯ কোটি টাকা (৬৩৮.৭৯ কোটি টাকায় সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড,এসটিপি, এসপিজিএস নির্মাণ ও ১৮৯.২০ কোটি টাকায় জমি উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণ মোট ৮২৭.৯৯ কোটি টাকা ২০% ঋণ ও ৮০% ইক্যুইটি)। বর্ণিত ইক্যুইটি সরকারি বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৩ সালের ১৮ জুন তারিখের পত্র অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াবে ১০৭৮.০০ কোটি টাকা (৬৩৯.০০ কোটি টাকায় সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড, এসটিপি, এসপিজিএস নির্মাণ ও ১৮৯.২০ কোটি টাকা অন্যান্য ব্যয় অর্থাৎ মোট ৮২৮.০০ কোটি টাকা ২০% ঋণ ও ৮০% ইক্যুইটি এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫০.০০ কোটি টাকা অনুদান হিসাবে বিবেচিত হবে)। 

ইতিমধ্যে ভূমি উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ স্থাপনসহ ১৫৫টি শিল্প ইউনিট/ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্ল¬ট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে সরকার এবং বিএফএলএলএফইএ ও বিটিএ  এর মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিএফএলএলএফইএ ও বিটিএ পরিবেশ আইন ও মহামান্য আদালতের নির্দেশনার আলোকে ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে প্রদত্ত অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থানান্তর প্রক্রিয়া সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সময়ে স্থানান্তরে ব্যর্থ হলে বিএফএলএলএফইএ ও বিটিএ সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড ইত্যাদি নির্মাণে বিনিয়োগকৃত অর্থ সরকারকে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড, এসটিপি, এসপিজিএস, সিসিআরইউ, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ইত্যাদি পরিচালনা, সংরক্ষণ ও মেরামত ব্যয় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ বহন করবে। 

ট্যানারী শিল্প স্থানান্তর কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে শিল্প ভবন নির্মাণ, হাজারীবাগ হতে যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ও সাভারে তা স্থাপন, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান, যন্ত্রপাতি ইরেকশন ও কমিশনিং ইত্যাদি। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে অতি দ্রুততার সাথে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ শুরু করতে হবে। অথচ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পর্যন্ত তাদের কোন কার্যক্রম শুরুই করেনি। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানান্তর ত্বরান্বিত করা না হলে সিইটিপির কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকা মহানগরীতে দূষণের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। 

পবার সরেজমিন পরিদর্শন ও জরীপ এবং  বিসিকের কর্মকর্তা এবং সিইটিপি নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও পরামর্শকদের সাথে মতবিনিময়ে জানা যায় যে, সিইটিপির ফাউন্ডেশনের ৭৫% কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে যা সিইটিপির ২৫%। অন্যদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ¯া’নান্তর কার্যক্রম অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৫টি পাইলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ১৯টি সীমানা দেয়াল, গার্ড রুম নির্মাণ করছে এবং বাকি ১২১টি কোন কার্যক্রম শুরু করেনি। 

বিসিকের প্রকল্প এলাকার অফিসটি দোতলা বিশিষ্ট। এতে ১০/১২ কক্ষ রয়েছে। এ অফিসে ১ জন সহকারী প্রকৌশলী, ২ জন ষ্টাফ, ১ জন দারোয়ান কাম পিয়ন কাম নাইট গার্ড রয়েছে। এখানে কোন কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফ্যাক্স মেশিন, ফটোকপিয়ার, টেলিফোন নেই। এমন অবস্থায় ট্যানারী শিল্প স্থানান্তরের মতো এমন বড় প্রজেক্টের অফিসের সক্ষমতা নিয়ে সরকারের আন্তরিকতায় প্রশ্ন থেকে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। উপস্থিত ছিলেন, পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ,  মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, গ্রীন মাইন্ড সোসাইটির সভাপতি আমির হাসান, জনউদ্যোগের সদস্য সচিব তারিক হোসেন মিঠুল, মো: মুসা প্রমুখ।

সুপারিশ
1.  শিল্প মালিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করা, প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে তাঁরা দ্রুততম সময়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উৎপাদনে যায়।
2.  ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে উৎপাদন শুরু এবং একই সময়ে সিইটিপি চালু করা।
3.  হাজারীবাগের ট্যানারীগুলোর মালিকদের কাছ থেকে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫২৯ (দুই হাজার পাচ শত উনত্রিশ) কোটি  টাকা আদায় করা।
4.   ইটিপি নির্মাণ মালিকদের দায়িত্ব। সিইটিপি নির্মাণ ব্যয় ট্যানারী মালিকগণ আবশ্যই সরকারকে পরিশোধ করবেন। কেননা এটা জনগণের টাকা।