হাজারীবাগ থেকে ট্যানারীসমূহ ডিসেম্বর’১৪ এর মধ্যে স্থানান্তর করতে হবে

হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহ থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এসব বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি পানি, বায়ু, মাটি দূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। বুড়িগঙ্গা নদীসহ মহানগরীর সার্বিক পরিবেশ রক্ষায় হাজারীবাগের ট্যানারী সাভারের শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও তার বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আজ ৩১ অক্টোবর ২০১৪, সকাল ১১ টায় হাজারীবাগের ঢাকা ট্যানারী মোড়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ ১৮ টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে দাবী জানানো হয় যে, সরকারের সাথে বিএফএলএলএফইএ এবং বিটিএ এর মধ্যে চুক্তি মোতাবেক চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারীসমূহ সাভারে স্থানান্তর করতে হবে। 

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন- হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অন্যতম কারণ।  মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ বুড়িগঙ্গা আজ একটি মৃত নদী। হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহ দৈনিক ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য বিপদ ডেকে আনছে । এছাড়াও  প্রতিদিন আনুমানিক ১০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য তৈরী হচ্ছে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকালে এর পরিমাণ প্রায় ২০০ মেট্রিক টন। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ফরমিক এসিড, বি¬চ, ডাই, তেল,  চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত অনেক ভারী ধাতু, চুন, পশুর মাংস, দ্রবীভূত চুল, চর্বি ইত্যাদি। এসব বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি পানি, বায়ু, মাটি দূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। 

মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ, পরিবেশবাদী সংগঠন ও জনগণের অব্যাহত আন্দোলন এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় ও কার্যকর ভ’মিকার ফলশ্রুতিতে ২০০২ সালের ২৭ জানুয়ারী সরকার হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ট্যানারি শিল্পসমূহকে ঢাকা জেলার সাভার ও কেরানীগঞ্জ উপজেলায় স্থানাšতরের কার্যক্রম গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ভূমি উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ স্থাপনসহ ১৫৫টি শিল্প ইউনিট/ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্ল¬ট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে সরকার এবং বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এন্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টাস এসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) ও বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন (বিটিএ)  এর মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিএফএলএলএফইএ ও বিটিএ পরিবেশ আইন ও মহামান্য আদালতের নির্দেশনার আলোকে ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে প্রদত্ত অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পাদনে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। চামড়া শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাগণ সকল ট্যানারী শিল্প ইউনিট, চামড়া উপজাত প্রক্রিয়াকরণ ও অন্যান্য শিল্প ইউনিটগুলো চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন নিশ্চিত করবে। পরিবেশ আইন ও মহামান্য আদালতের নির্দেশনার আলোকে শিল্পনগরীতে কারখানা স্থানান্তরে ব্যর্থ হলে বিএফএলএলএফইএ ও বিটিএ সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড ইত্যাদি নির্মাণে বিনিয়োগকৃত অর্থ সরকারকে প্রদান করতে বাধ্য থাকবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে সিইটিপি, সিসিআরইউ, ডাম্পিং ইয়ার্ড, এসটিপি, এসপিজিএস, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ইত্যাদি পরিচালনা, সংরক্ষণ ও মেরামত ব্যয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ বহন করবে।

হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহের স্থানাšতর বিলম্বিত হওয়ায় দূষণ অব্যাহত রয়েছে এবং মহানগরীর জনগণও গুরুতর শারিরীক ঝুকিতে রয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ¯হাপনসহ হাজারীবাগ¯হ ট্যানারীসমূহ স্থানাšতরের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ হ্রাস পাবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি রপ্তানীর স্বার্থে (বিশেষ করে ইউ-তে) হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ জরুরীভিত্তিতে সাভারে স্থানাšতরের লক্ষ্যে সরকার এবং ট্যানারীর মালিকদের সম্মিলিত প্রয়াশ অত্যাবশ্যক। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ¯হাপন এবং ট্যানারীসমূহ স্থানান্তর কার্যক্রম যুগপৎভাবে চালাতে হবে। ট্যানারীসমূহ উৎপাদনে না যাওয়া পর্যšত বর্জ্য শোধনাগারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না এবং তা চালু করাও সম্ভব হবে না। ফলে  ১০৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করেও পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কোন সুফল পাওয়া যাবে না।

মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও নাসফের সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না,  গ্রীণ মাইন্ড সোসাইটির সভাপতি আমির হাসান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিশিষ্ঠ কলামিস্ট এ কে এম নুরুল হক, পবার নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, মডার্ণ ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নূরুল হক আরজু, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসা, রাইটার্স ফোরামের সভাপতি হুমায়ুন আহম্মেদ মন্টু, গ্রীণের সদস্য সচিব আনিসুল হোসেন তারিক, ইউপিএফের সভাপতি জহিরুল ইসলাম জনি, ডাব্লিউবিবির প্রকল্প কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

মানববন্ধন থেকে নিন্মোক্ত দাবী জানানো হয়-

১.    শিল্প মালিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করা, প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে তাঁরা দ্রুততম সময়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উৎপাদনে যায়।
২.    ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সিইটিপি চালু করা এবং একই সময়ে মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু।
৩.    বিসিক, বিএফএলএলএফইএ এবং বিটিএ এর মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী হাজারীবাগের যে সকল ট্যানারী ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরে ব্যর্থ হবে সে সকল ট্যানারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ চামড়া শিল্পনগরীর প্লট বাতিল করা এবং হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দেয়া। 
৪.    সিইটিপি নির্মাণ মালিকদের দায়িত্ব। সিইটিপি নির্মাণ ব্যয় ট্যানারী মালিকগণ ১৫ বছর মেয়াদী কি¯িতর মাধ্যমে সরকারকে পরিশোধ করবেন। কেননা এটা জনগণের টাকা। সরকার জনগণের টাকায় চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তুলেছে এবং সিইটপির জায়গাও  দিচ্ছে।
৫.    শিল্পনগরীতে শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৬.    চামড়া শিল্পনগরীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া, ডে কেয়ার সেন্টার, চিকিৎসা সুবিধা, ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। 
৭.    হাজারীবাগের ট্যানারীগুলোর মালিকদের কাছ থেকে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫২৯ (দুই হাজার পাঁচ শত উনত্রিশ) কোটি  টাকা আদায় করা।
৮.    হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ স্থানান্তরের পর এ এলাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি গড়ে তোলা।