বর্তমান অবস্থায় ট্যানারী স্থানান্তরে মালিকদের বাধ্য করতে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ

মহানগরী ঢাকার অন্যতম প্রধান দূষণকারী ট্যানারী শিল্প সাভারস্থ চামড়া শিল্প নগরীতে ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে অপারেশনে যাওয়ার কথা। পবা প্রকল্প এলাকা নিয়মিত পরিদর্শন, জরিপ ও পর্যবেক্ষণ করে আসছে। পবা বিভিন্ন সময়ে হাজারীবাগ ট্যানারী এলাকার দূষণ ও সাভার ট্যানারী শিল্প এলাকার কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন, জরিপ ও পর্যবেক্ষণ করে। সর্বশেষ ১৪ মে ২০১৫ তারিখে পবার একটি প্রতিনিধি দল ট্যানারী শিল্প স্থানান্তর কার্যক্রমের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন, জরিপ, পর্যবেক্ষণ করে। সরেজমিন পরিদর্শন, জরীপ হতে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ¯া’নান্তর কার্যক্রম অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। সিইটিপির নির্মাণ অগ্রগতি দেখে মনে হচ্ছে জুন ২০১৫ সময়ের মধ্যে সিইটিপি চালু করা সম্ভব হবে না। ট্যানারীগুলো সাভারে স্থানান্তরে মালিকদের বাধ্য করার লক্ষ্যে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আজ ১৭ মে ২০১৫, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে উক্ত প্রতিবেদন প্রকাশে সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়। 

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ দীর্ঘ ৬৫ বছর বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ করে যাচ্ছে।  মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ বুড়িগঙ্গার পানি শিল্প, কৃষি, গৃহস্থালী কাজে এবং পরিশোধন করেও খাবার পানি হিসেবে ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। নদী এতই দূষিত যে নদীর পানি থেকে নদী ও নদীর আশেপাশের এলাকায় তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বুড়িগঙ্গা আজ একটি মৃত নদী, যেখানে দ্রবিভ’ত অক্সিজেন (ডিও) প্রায় শূণ্য। হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহ দৈনিক ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এছাড়াও প্রতিদিন আনুমানিক ১০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য তৈরী হচ্ছে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকালে এর পরিমাণ প্রায় ২০০ মেট্রিক টন। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ফরমিক এসিড, বি¬চ, ডাই, তেল,  চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত অনেক ভারী ধাতু, চুন, পশুর মাংস, দ্রবীভূত চুল, চর্বি, লবন ইত্যাদি। এসব বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি পানি, বায়ু, মাটি দূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। 

১৯৫০ সাল থেকে হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো অপরিশোধিত তরল বর্জ্য পরিবেশে নিক্ষেপ করে পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে। ৬৫ বছরে পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ ২৬০৯,৭৫,০০,০০০ (দুই হাজার ছয় শত নয় কোটি পচাত্তর কোটি) টাকা।পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী পরিবেশগত ক্ষতি নিরূপণ ও তা আদায়ের বিধান রয়েছে বিধায় উক্ত পরিমান অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ শিল্প মালিকদের থেকে আদায়যোগ্য।

পবার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- ২০১৫ সালের ০৮ মার্চ পর্যন্ত ১৫৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১টি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাই হয়ে তৃতীয় তলার কাজ চলছে; ৮টি প্রতিষ্ঠানের প্রথম তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে বা হওয়ার পথে; ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের পাইলিং সম্পন্ন বা চলছে, বেইজ ঢালাই হয়েছে বা হচ্ছে, গ্রেটভীম ঢালাই হয়েছে বা হচ্ছে; ৭৬টির সীমানা দেয়াল দেয়া হয়েছে; ১৪টির সীমানা দেয়াল,গার্ড রুম কিছুই করা হয়নি, ২৫টির সাইন বোর্ড নেই (এর মধ্যে ৮টির সীমানা দেয়াল,গার্ড রুম কিছুই করা হয়নি) । ৬% প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন সম্পন্ন করেছে, ৩৬% ফাউন্ডেশনের কাজ করছে এবং ৫৮% শিল্প ভবন নির্মাণে কিছুই করছে না। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৫টি পাইলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ১৯টি সীমানা দেয়াল, গার্ড রুম নির্মাণ করছে এবং বাকি ১২১টি কোন কার্যক্রম শুরু করেনি। 

জরীপের সময়    ফাউন্ডেশন সম্পন্ন করেছে    ফাউন্ডেশনের কাজ করছে    শিল্প ভবন নির্মাণে কিছুই করছে না
১৪ মে ২০১৫    ১০%    ৪০%    ৫০%
০৮ মার্চ ২০১৫    ৬%    ৩৬%    ৫৮%
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪    -    ১০%    ৯০%
ট্যানারীতে প্রচুর লবন ব্যবহার করা হয়। লবন পরিশোধনের কোন ব্যবস্থা সিইটিপিতে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া, ডে কেয়ার সেন্টার, চিকিৎসা সুবিধা, ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদির ব্যবস্থা শিল্প এলাকায় গড়ে তোলার বিষয়ে প্রকল্পে কিছুই উল্লেখ নেই। ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের অংশ বিশেষে বাঁধ নেই। চামড়া নগরীর রাস্তায় আলোর কোন ব্যবস্থা নেই।

স্থানান্তর কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে শিল্প ভবন নির্মাণ, হাজারীবাগ হতে যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ও সাভারে তা স্থাপন, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান, যন্ত্রপাতি ইরেকশন ও কমিশনিং, ইত্যাদি। সিইটিপি নির্মাণ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ একই সঙ্গে সমান্তরালে চলতে হবে যাতে করে একটির জন্য অন্যটিকে বসে থাকতে না হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর তরান্বিত করা না হলে সিইটিপির কার্যক্রম ব্যহত হবে এবং বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকা মহানগরীতে দূষণের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। তাই সরকারের প্রয়োজন শিল্প মালিকদের উপর চাপ প্রয়্গো করা, বিদ্যমান আইনে সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে তারা দ্রুততম সময়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উৎপাদনে যায়।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পবার নির্বাহী সদস্য ও পীসের মহাসচিব ইফমা হোসাইন, পবার নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, পবার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য মনজুর হাসান দিলু, পবার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, পবার সহ সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

পবা থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশ জানানো হয়-
ক্স    সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিশেষ করে শিল্প, পরিবেশ ও বন, অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনপূর্বক হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো সাভারে স্থানান্তরে মালিকদের বাধ্য করার লক্ষে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ক্স    ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে হাজারীবাগের যেসব ট্যানারী সাভারে স্থানান্তরিত উৎপাদন শুরু করবে না তাদের প্লট বাতিল করা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর আওতায় হাজারীবাগের ট্যানারীগুলো বন্ধ করে দেয়া বা পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৬০৯ কোটি টাকা আদায় করা, চলতি মূলধন না দেয়া ( জাতীয় পরিবেশ কমিটির ২য় বৈঠকের সিদ্ধান্তে আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক এর ২৮ অক্টোবর ১৯৯৭ তারিখের বিআরপিডি সাকুলার লেটার নং-১২ প্রযোজ্য)। 
ক্স    ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে উৎপাদন শুরু এবং একই সময়ে সিইটিপি চালু করা। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু এবং একই সময়ে সিইটিপি চালু করা না হলে সিইটিপি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে দূষণ অব্যাহত থাকবে এবং সিইটিপি নির্মাণে ব্যয়িত বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হবে। ট্যানারী কারখানাগুলোর চালু না হলে বর্জ্যরে অভাবে সিইটিপি অকার্যকর হয়ে যাবে। 
ক্স    প্রত্যেকটি কারখানা ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং দ্বিপাক্ষিক চ’ক্তি করা এবং পরবর্তীতে মনিটরিং করা।
ক্স    ট্যানারীতে প্রচুর লবন ব্যবহার করা হয়। লবন পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
ক্স    শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া, ডে কেয়ার সেন্টার, চিকিৎসা সুবিধা, ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদির ব্যবস্থা শিল্প এলাকায় গড়ে তোলা।
ক্স    ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের অংশবিশেষে বাঁধ নির্মাণ ।
ক্স    চামড়া নগরীর রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা ।
ক্স    ইটিপি নির্মাণ মালিকদের দায়িত্ব। সিইটিপি নির্মাণ ব্যয় ট্যানারী মালিকগণ আবশ্যই সরকারকে পরিশোধ করবেন। কেননা এটা জনগণের টাকা।