ট্যানারী স্থানান্তরের বাস্তব কোন অগ্রগতি নেই

মহানগরী ঢাকার প্রাণসম বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হাজারীবাগের ট্যানারী শিল্পসমূহ। বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে ট্যানারীগুলো সাভারস্থ চামড়া শিল্প নগরীতে ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই স্থানান্তরের সর্বশেষ সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। পবা ট্যানারী স্থানান্তর কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়মিত মনিটরিং করে আসছে। নিয়মিত মনিটরিং - এর আওতায় বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন এবং প্রকল্প পরিচালক ও সিইটিপি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সভাসহ সর্বশেষ ০৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে পবার একটি প্রতিনিধি দল ট্যানারী শিল্প স্থানান্তর কার্যক্রমের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন, জরিপ, পর্যবেক্ষণ করে পবার মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে আজ ১৪ মার্চ ২০১৫, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে উক্ত প্রতিবেদন প্রকাশে একটি সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ করে। পবার মূল্যায়নে দেখা যায় যে, নির্ধারিত সময়ে ট্যানারী স্থানান্তরের জন্য শিল্প মালিকদের কাজের বাস্তব কোন অগ্রগতি হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। উপস্থিত ছিলেন পবার নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ,  সহ-সম্পাদক মো: সেলিম, মো: মুসা, পীসের মহাসচিব ইফমা হোসাইন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়-হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ দীর্ঘ ৬৫ বছর বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ করে যাচ্ছে। মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ বুড়িগঙ্গা আজ একটি মৃত নদী। ট্যানারীসমূহ দৈনিক ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এছাড়াও  প্রতিদিন আনুমানিক ১০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য তৈরী হচ্ছে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকালে এর পরিমাণ প্রায় ২০০ মেট্রিক টন। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ফরমিক এসিড, বি¬চ, ডাই, তেল,  চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত অনেক ভারী ধাতু, চুন, পশুর মাংস, দ্রবীভূত চুল, চর্বি, লবন ইত্যাদি। এসব বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি পানি, বায়ু, মাটি দূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। 

পবার একটি প্রতিনিধি দল ২০১৪ সালের ২১ আগষ্ট ও ১৩ সেপ্টেম্বর সাভারস্থ চামড়া শিল্পনগরী সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক জরীপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিনিধি দল ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগ ও বুড়িগঙ্গা নদী সরেজমিন পরিদর্শন করে। এছাড়াও পরিদর্শনকালে বিসিকের কর্মকর্তা এবং সিইটিপি নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও পরামর্শকদের সাথে মতবিনিময়সহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। পবার সরেজমিন পরিদর্শন ও জরীপে প্রাপ্ত ফলাফল ভিত্তিতে একটি প্রতিবেন প্রস্তুত করে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ০৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে পবার একটি প্রতিনিধি দল ট্যানারী শিল্প স্থানান্তর কার্যক্রমের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন, জরিপ, পর্যবেক্ষণ করে পবার মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ।

প্রতিবেদনে বলা হয়-বরাদ্দকৃত ১৫৫টি ট্যানারীর মধ্যে প্রায় সবগুলোই ৬ তলাবিশিষ্ট শিল্প ভবন হবে। এর মধ্যে মাত্র ১টি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাই হয়ে তৃতীয় তলার কাজ চলছে; ৮টি প্রতিষ্ঠানের প্রথম তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে বা হওয়ার পথে; ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের পাইলিং সম্পন্ন বা চলছে, বেইজ ঢালাই হয়েছে বা হচ্ছে, গ্রেটভীম ঢালাই হয়েছে বা হচ্ছে; ৭৮টির সীমানা দেয়াল দেয়া হয়েছে; ১৪টির সীমানা দেয়াল,গার্ড রুম কিছুই করা হয়নি; ২৫টি কোন সাইন বোর্ড নেই (এর মধ্যে ৮টির সীমানা দেয়াল,গার্ড রুম কিছুই নেই)।
 
প্রকল্প পরিচালকের সাথে আলোচনায় জানা যায় যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের লে-আউট অনুমোদন করা হয়েছে। সিইটিপিতে সাধারণতঃ প্রতিদিন ৫০০০ ঘনমিটার এবং ঈদের সময় ২০০০০ ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করা হবে। ক্রোমিয়াম আলাদাভাবে পরিশোধন করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পুনরায় ব্যবহার করা হবে। সিইটিপি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান যে ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে সিইটিপির নির্মান সম্পন্ন হবে এবং এটি একটি বায়োলোজিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। তারা শংকিত যে বর্জ্যের অভাবে তারা যথাসময়ে সিইটিপি কমিশনিং এ সমস্যায় পড়বেন। 

সরেজমিন পরিদর্শন, জরীপ, প্রকল্প পরিচালকের সাথে আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ¯া’নান্তর কার্যক্রম অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। ২০১৫ সালের ০৮ মার্চ পর্যন্ত ১৫৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১টি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাই হয়ে তৃতীয় তলার কাজ চলছে; ৮টি প্রতিষ্ঠানের প্রথম তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে বা হওয়ার পথে; ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের পাইলিং সম্পন্ন বা চলছে, বেইজ ঢালাই হয়েছে বা হচ্ছে, গ্রেটভীম ঢালাই হয়েছে বা হচ্ছে; ৭৬টির সীমানা দেয়াল দেয়া হয়েছে; ১৪টির সীমানা দেয়াল,গার্ড রুম কিছুই করা হয়নি, ২৫টির সাইন বোর্ড নেই (এর মধ্যে ৮টির সীমানা দেয়াল,গার্ড রুম কিছুই করা হয়নি)। ৬% প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন সম্পন্ন করেছে, ৩৬% ফাউন্ডেশনের কাজ করছে এবং ৫৮% শিল্প ভবন নির্মাণে কিছুই করছে না। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৫টি পাইলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ১৯টি সীমানা দেয়াল, গার্ড রুম নির্মাণ করছে এবং বাকি ১২১টি কোন কার্যক্রম শুরু করেনি। 

স্থানান্তর কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে শিল্প ভবন নির্মাণ, হাজারীবাগ হতে যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ও সাভারে তা স্থাপন, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান, যন্ত্রপাতি ইরেকশন ও কমিশনিং, ইত্যাদি। সিইটিপি নির্মাণ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ একই সঙ্গে সমান্তরালে চলতে হবে যাতে করে একটির জন্য অন্যটিকে বসে থাকতে না হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর তরান্বিত করা না হলে সিইটিপির কার্যক্রম ব্যহত হবে এবং বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকা মহানগরীতে দূষণের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। তাই সরকারের প্রয়োজন শিল্প মালিকদের উপর চাপ প্রয়্গো করা, বিদ্যমান আইনে সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে তারা দ্রুততম সময়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উৎপাদনে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে নিন্মোক্ত সুপারিশ করা হয়-
০.    শিল্প মালিকদের উপর চাপ প্রয়োগ করা, বিদ্যমান আইনে সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে তাঁরা দ্রুততম সময়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে, যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উৎপাদনে যায়।
১.    ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে উৎপাদন শুরু এবং একই সময়ে সিইটিপি চালু করা। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু এবং একই সময়ে সিইটিপি চালু করা না হলে সিইটিপি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে দূষণ অব্যাহত থাকবে এবং সিইটিপি নির্মাণে ব্যয়িত বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হবে।
২.    ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে উৎপাদন শুরু করবে না তাদের প্লট বাতিল করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩.    হাজারীবাগের ট্যানারীগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-এর আওতায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ট্যানারীর মালিকদের কাছ থেকে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৬০৯.৭৫ কোটি  টাকা আদায় করা।
৪.    ট্যানারীতে প্রচুর লবন ব্যবহার করা হয়। লবন পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
৫.    শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া, ডে কেয়ার সেন্টার, চিকিৎসা সুবিধা, ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদির ব্যবস্থা শিল্প এলাকায় গড়ে তোলা।
৬.    ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের অংশ বিশেষে বাঁধ নির্মাণ ।
৭.    চামড়া নগরীর রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা ।
৮.    ইটিপি নির্মাণ মালিকদের দায়িত্ব। সিইটিপি নির্মাণ ব্যয় ট্যানারী মালিকগণ আবশ্যই সরকারকে পরিশোধ করবেন। কেননা এটা জনগণের টাকা।