স্টেশন মাষ্টারের অবহেলায় নরসিংদীর রেল দূর্ঘটনা ঘটেছে পবা নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন

কর্তব্যরত রেল স্টেশন মাষ্টারের ভুল সিগন্যাল বা ক্লিয়ারেন্সের কারণে নরসিংদীর ভয়াবহ রেল দূর্ঘটনা ঘটেছে। ট্রেনের চালক সিগন্যাল অমান্য করে এ দূঘর্টনা ঘটিয়েছে তার কোন গ্রহণযোগ্য প্রমান পাওয়া যায়নি। নিরপেক্ষতার স্বার্থে এবং ভবিষ্যতে দূর্ঘটনা এড়াতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। ১১ ডিসেম্বর ২০১০ সকাল ১১ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র সম্মেলন কক্ষে নরসিংদীর দূর্ঘটনার প্রেক্ষিতে পবা-র কর্তৃক গঠিত নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়। 

উক্ত সংবাদ সম্মেলনে সভাপত্বি করেন পবার নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক এ এম এম শফিউল্লাহ, সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী রাজেকুজ্জামান রতন, পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, নীতিবিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম, রেল গবেষক নাজমূল করিম, পরিবেশকর্মী ইবনুল সাইদ রানা। উল্লেখ্য যে, গত ০৮ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে নরসিংদী স্টেশনে দূর্ঘটনার প্রেক্ষিতে পবা ৭ সদস্যের একটি নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই তদন্ত দল সরেজমিন পরিদর্শন, স্থানীয় জনগণ, সাংবাদিক, রেল কর্মকর্তাদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত ভিত্তি করে এই প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ, মহানগর গোধূলী এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রাবিরতির জন্য নরসিংদী স্টেশনের ১ নম্বর লাইনে থামার পর এবং চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি আজমেরীগঞ্জ হতে ক্লিয়ারেন্স পেলে ২ নম্বর লাইন দিয়ে সরাসরি চলে যাওয়া কথা। কিন্তু মহানগর গোধূলী এবং চট্টলা এক্সপেস ট্রেনটি একই সময় একসাথে এক নম্বর লাইনে প্রবেশ করায় এই দূঘর্টনার সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা চট্টলা ট্রেনটির নরসিংদী স্টেশনের অনুমতি ছাড়া আজমেরী গঞ্জ হতে ছেড়ে আসতে পারে না। অর্থাৎ এখানে নরসিংদী স্টেশন কর্তৃপক্ষের আজমেরীগঞ্জ ছেড়ে আসার ক্লিয়ারেন্স দূঘর্টনার মূল কারণ। তদন্ত প্রতিবেদন দায়িত্ব অবহেলা করে স্টেশন মাষ্টার ফ্লাটফরমে বিভিন্ন বানিজ্যিক কার্যক্রমের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ রয়েছে। 

রেল কর্তৃপক্ষের মতে, আউটার সিগন্যাল অমান্য করে ট্রেন চালকের হোম সিগন্যালের প্রবেশ করায় এই দূঘর্টনার হয়। পবা-র নাগরিক কমিটির প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায় এই দূঘর্টনার শুধুমাত্র চালককে এককভাবে দায়ী করা কোন ভাবেই যৌক্তিক নয়। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা চট্টলা ট্রেনটির নরসিংদী স্টেশনের অনুমতি ছাড়া আজমেরী গঞ্জ হতে ছেড়ে আসতে পারে না। অর্থাৎ এখানে নরসিংদী স্টেশন কর্তৃপক্ষের আজমেরীগঞ্জ ছেড়ে আসার ক্লিয়ারেন্সই দূঘর্টনার মূল কারণ। চট্টলা ট্রেনটি হার্ডব্রেকের মাধ্যমে থামানোর জন্য ড্রাইভার চেষ্টা চালান যাতে রেললাইন ও চাকার ঘর্ষণে প্রচুর অগ্নিফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়। ট্রেনের চালক একজন পুরাতন ও অভিজ্ঞ লোক যিনি দীর্ঘদিন ধরে এই লাইনে চলাচল করে, তার সুনিশ্চিত জ্ঞান রয়েছে এখানে সিঙ্গেল লাইন এবং অন্যান্য ট্রেনের ক্রসিং থাকতে পারে। ভৈরব বাজার স্টেশনে চট্টলা ট্রেনটির যাত্রাবিরতি ছিল এবং নরসিংদী স্টেশনের পূর্বে ছয়টি স্টেশন রয়েছে। নিয়ম অনুসারে একটি স্টেশন লাইন ক্লিয়ার দেয়ার পূর্বে আগের স্টেশনগুলো হতে ক্লিয়ারেন্স গ্রহণ করে। এছাড়া চট্টলা ট্রেনটি ২ নং রেল লাইন দিয়ে সরাসরি চলে যাবে এবং মহানগর ট্রেনটি ১ নং লাইনে অবস্থান করবে। তবে কেন চট্টলা ট্রেনটির সংযোগ ২ নম্বর লাইনে না দিয়ে এক নম্বর লাইনে আসতে বাধ্য করা  হলো তা বোধগম্য নয়।  

বক্তারা আরও বলেন রেলের এ দূঘর্টনা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিনের রেলের অব্যবস্থপনা এবং অবহেলার বর্হিপ্রকাশ এই অব্যাহত দূঘর্টনা। কিন্তু এসকল দূঘর্টনার কারণ আজো মানুষ জানে না, এসকল তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে এ ধরনের নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে দূঘর্টনার সঠিক কারণ এবং প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে রেলের দূর্বলতাগুলো কাঠানো সম্ভব হতো। তবে রেলের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হলে এর সিংগভাগই এড়ানো সম্ভব ছিল। বিশ্বব্যাংক ও আই এম এফ এর  স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ঋণ প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নের নামে পরিকল্পিতভাবে রেলকে সংকুচন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন করার প্রচেষ্টার কারণেই রেলে এই দুরাবস্থা। 

এ সকল কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে রেলের লাইন ও ষ্টেশন কমানো হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে লাইন সংস্কার, নতুন বগি বা ইঞ্জিন ক্রয় হয়নি, রেল মেরামত ও তৈরির কারখানা বন্ধ অথবা সংকুচিত করা হয়েছে। অধিকাংশগুলো লাইন (পাথ ও স্লিপার অপর্যাপ্ত) ও সিগন্যালগুলোর সংস্কার না করার কারণে আজ অহরত ছোট বড়া দূঘর্টনা ঘটছে, গাড়ী লাইনচুত্য হচ্ছে। অথচ ঋণে বিপুল অর্থ ব্যয় করে স্টেশন আধূনিকায়ন করা হয়েছে।

বক্তারা অবিলম্বে দূর্ঘটনার তথ্যাদি জানার সুবিধার্থে একটি তথ্য কেন্দ্র কেন্দ্রীয়ভাবে এবং নরসিংদীতে স্থাপন করার পরামর্শ দেন। আহতদের সঠিক চিকিৎসার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ, সিগন্যালের কারণে সৃষ্ট দূঘর্টনার দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও শাস্তি প্রদান, এটি দূঘর্টনা না নাশকতা তা গোয়ান্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করার সুপারিশ করেন। টিকেটে যাত্রীর নাম পরিচয় রাখার বিধান বাধ্যতামূলক করা এবং রেলের কর্মীদের মনোবল ও প্রেরণা বৃদ্ধিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করার সুপারিশ করেন। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রামের রেললাইন দ্রুততার সাথে ডাবল করা, রেলের উন্নয়ন ও প্রসার, মনিটরিং, কার্যক্রমের গতিশীলতা ও জনমূখী করার স্বার্থে রেলের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা এবং দেশব্যাপী রেল কেন্দ্রিক সমন্বিত যাতায়াত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা এবং সর্বোপরি মহান জাতীয় সংসদের মাধ্যমের একটি মাষ্টার প্লান তৈরি ও বাস্তবায়ন করার সুপারিশ প্রদান করা হয়।