নৌ-পথ ও নৌ নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা ঃ করণীয়

জাহাজের নকশা অনুমোদন, সার্ভে ও রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট প্রদান, লঞ্চে যাত্রীবোঝাইকরণ, যাত্রীবাহী নৌ যানের চলাচলের অনুমতি প্রদান ও চলাচল নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় নৌ দুর্ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটছে। সেই সাথে সকল সরকারের সময়েই সড়কমুখী উন্নয়ন কর্মকৌশল এবং নদীবিমুখ নীতির ফলে নৌপথে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। আইন প্রয়োগে অবহেলা ও নৌপথে সমন্বিত কার্যক্রমের অভাব অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনের অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা, দুর্ঘটনা-দুর্যোগ এবং অক্ষমতার মূল কারণ বলে আমরা মনে করি। আজ ১২ আগস্ট ২০১৪, মঙ্গলবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলন পবা’র উদ্যোগে “নৌ-পথ ও নৌ নিরাপত্তার বর্তমান অবস্থা ঃ করণীয়” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

গত ৪ আগস্ট মাওয়ার কাছে পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চের দুর্ঘটনায় অসংখ্য যাত্রীর প্রাণহানি এবং লঞ্চটি সনাক্ত করা ও উদ্ধার করার ব্যর্থতার ফলে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনের অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা, অক্ষমতা এবং অসহায়ত্ব সারাদেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে তা হলো নৌ দুর্ঘটনার ফলে আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের প্রাণের বিনিময়েও আমরা ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করার কোন শিক্ষা গ্রহণ করিনি। 

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কমপক্ষে দুইটি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তদন্ত কমিটির মূল প্রতিবেদন পর্যালোচনা করার সুযোগ পাইনি। প্রতিবেদন সরকারিভাবে প্রকাশ করার রেওয়াজ এখনও চালু হয়নি। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর সংবাদপত্রের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তা প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ক্লিপিং, তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে নৌ দুর্ঘটনার যে কারণসমূহ জানা গেছে তা হলো- অতিরিক্ত ও বিপজ্জনক বোঝাই, ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো, চালকের অদক্ষতা, মুখোমুখি সংঘর্ষ/ডুবোচর বা নিমজ্জিত বস্তুর সাথে সংঘর্ষ, বিরূপ আবহাওয়ায় নৌযান পরিচালনা। দুর্ঘটনার পিছনে একাধিক কারণ কাজ করেছে। সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায় যে, দুর্বল কাঠামোর একটি যাত্রীবাহী নৌযান বিপজ্জনকভাবে যাত্রী বোঝাই করে বিরুপ আবহাওয়ায় চলাচলের সময় দুর্ঘটনাকে অনিবার্য করে তুলেছে। এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে চালকের দক্ষতার অভাব এবং ভ’ল সিদ্ধান্তের কারণেও দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। 

ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স এর ৪৪ ধারা অনুসারে মহাপরিচালক সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃক গঠন করা তদন্ত কমিটি নৌ আদালতে বিচারিক কার্যক্রমের জন্য বিবেচনা করা হয়। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠন করা তদন্ত কমিটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা রোধে পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠন করা হয়। জাহাজের নকশা অনুমোদন, সার্ভে ও রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট প্রদান এবং যাত্রীবাহী নৌ যানের চলাচলের অনুমতি প্রদান ও চলাচল নিয়ন্ত্রণের দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এইসব কমিটির প্রতিবেদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেনা। দুর্ঘটনার কারণসমূহ সনাক্ত করে ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে তা দুর করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন অনুসন্ধান সেল গঠনের সুপারিশ দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়িত হয়নি। 

ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স এর ৬৭ (এ) ধারায় অতিরিক্ত যাত্রী বহনের অপরাধে মালিক/প্রতিনিধি/মাস্টারের ২ বছর কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স এর ৬৭(বি) ধারায় অতিরিক্তি প্রতিযাত্রী বহনের জন্য ৩০০ টাকা জরিমানা যা সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকার বিধান রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য রাখেন, পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার মনোয়ার হোসেন। উপস্থিত ছিলেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, কামাল পাশা চৌধুরী, নিরাপদ নৌ পথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল বাবুল, শিপিং কপোরেশনের সাবেক ডিজিএম সৈয়দ আশরাফ আফরোজ, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, পবার সদস্য মো: সেলিম, পীসের মহাসচিব ইফমা হোসেন প্রমুখ।
আমাদের সুপারিশগুলো নি¤œরূপ: 
১.    ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬ যা ২০০৫ সালে সংশোধিত তার যথাযথ বাস্তবায়ন।
২.    নৌ পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করা।
৩.    নৌযানের নকশা প্রণয়ন ও অনুমোদন ও নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধান, সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট প্রদান প্রভৃতি কাজের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে। একজন সার্ভেয়ারের বদলে একজন নৌ প্রকৌশলী, একজন মাস্টার মেরিনার এবং একজন নৌ স্থপতির সমন্বয়ে টিম গঠন করে সার্ভে করার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে চলাচলকারী যাত্রীবাহী নৌযানগুলোর মধ্যে বিপজ্জনক কাঠামোয় নির্মিত নৌযান সনাক্ত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। বিপজ্জনক হিসেবে সনাক্তকৃত যাত্রীবাহী নৌযানের সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন বাতিল/স্থগিত করতে হবে। 
৪.    সড়ক পথের মতো নৌ পথেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করার জন্য একটি বাহিনী গঠন করতে হবে। কেবলমাত্র প্রধান প্রধান নৌবন্দর নয় সকল স্টেশনে যাত্রী বোঝাই নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিদর্শন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পথিমধ্যের লঞ্চগুলোর ইজারা প্রথা বিলোপ করে সেগুলোকে নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে রুপান্তর করতে হবে।
৫.    নৌ পথের নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খনন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে হবে। যথোপযুক্তভাবে ঘুুুর্ণিপাক, তীব্রস্্েরাত ও বিপজ্জনক স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে সিগন্যালিং ব্যবস্থাকে আরও সুনিবিড় করতে হবে।
৬.    নৌযান চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। কম্পিটেন্সী সার্টিফিকেট প্রদান এবং সার্টিফিকেট নবায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যাত্রীবাহী নৌযান চালনার যোগ্যতার পূর্বশর্ত হিসেবে প্যাসেঞ্জার এনডোর্সমেন্ট সার্টিফিকেট গ্রহণ বাধ্যতামুলক করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নৌ দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বাধীন স্থায়ী অনুসন্ধান সেল গঠন করতে হবে। তারা যেমন দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করবেন তেমনি ভবিষ্যতে ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশের বাস্তবায়নও অনুসরণ করবেন। বিচারিক কার্যক্রমের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিতে মেরিন সেফটি অফিসারের সঙ্গে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রন বর্হিভ’ত কর্মকতা ও ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। 
৭.    ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অবিলম্বে লাশ উদ্ধার এবং নিমজ্জিত নৌযান উত্তোলনের প্রস্তুতিমূলক কার্য সম্পাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে সহজে বহনযোগ্য সরঞ্জাম নিয়ে মোবাইল ইউনিট গঠন করতে হবে। বাংলাদেশের নদ-নদী ও পানি প্রবাহের বিশেষ বৈশিষ্ঠের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। যাতে সহজে নিমজ্জিত নৌযান সনাক্ত করা যায়।
৮.    আইনের বিধান অনুসারে নৌ পরিবহন প্রধান জেলাগুলোতে নৌ আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 
৯.    আবহাওয়া ও নৌ পথের তথ্য-উপাত্ত জাহাজে সার্বক্ষণিক সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০.    নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য দ্বৈত ব্যবস্থাপনার বিলোপ সাধন করে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে।
১১.    নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।