ঢাকার অস্তিত্ব রক্ষায় লেকসমূহের দূষণ ও দখল বন্ধ করতে হবে

ঢাকার অস্তিত্ব রক্ষায় লেকসমূহের দূষণ ও দখল বন্ধ করতে হবে

পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য লেক হচ্ছে একটি আদর্শ জলাধার। এসব উপযোগীতা বিবেচনা করে ঢাকার লেকসমূহের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু ঢাকার লেকসমূহ ক্রমেই দূষণ ও দখল হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার অস্তিত্বের প্রয়োজনেই লেকসমূহের দূষণ ও দখল বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র ২০১৩ সালের জুন মাস থেকে ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আলোকে একটি প্রতিবেদনে এই দাবী জানানো হয়। আজ ১২ এপ্রিল ২০১৬, মঙ্গলবার, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে উক্ত সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

          পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের আলোকে বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য তারিক হাসান মিঠুল, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি রাজিয়া সামাদ, বিআইডব্লিউটিএ-র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, প্রকৌশলী আবদুস সাত্তার, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।

প্রতিবেদনে বলা হয়- লেক বিশাল পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে, বন্যা ও খরার প্রভাব থেকে রক্ষা করে। লেক পরিবেশগত সুফল প্রদান করে, জীবনের গুণগত মানে প্রভাব ফেলে এবং অর্থনীতিকে মজবুত করে। লেক বিশাল পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করে, বন্যা ও খরার প্রভাব থেকে রক্ষা করে। লেক ভ’গর্ভস্থ পানি পুনরায় পূর্ণ করে, এলাকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জীবজন্তু ও গাছপালার স্বাভাবিক আবাসস্থল নিরাপদ রাখে। লেক চিত্তবিনোদন ও পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের দিক থেকেও লেকের গুরুত্ব রয়েছে, লেক পৌর এলাকায় পানীয় জলে উৎস হতে পারে। লেককে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য পানি সরবরাহ এবং কৃষির জন্য সেচের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। লেক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম, এর প্রতি যতœ নেয়া হলে তা জলজ জীবনের সুস্থ ভারসাম্য রক্ষা, আমাদের আনন্দ প্রদান এবং আর্থ-সামাজিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করতে সক্ষম।

এ নগরী চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। দূষণ, দখল, ভরাটের ফলে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আজ মৃত প্রায় এবং এগুলোর অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখীন। অন্য দিকে এ শহরে যে পরিমান নি¤œাঞ্চল রয়েছে তার প্রায় ৭০% ইতিমধ্যে ভরাট করা হয়েছে। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নি¤œাঞ্চল হারিয়ে যাবে। ঢাকার নি¤œাঞ্চল এবং চারদিকে নদীগুলো ছাড়া যে জলাভ’মি রয়েছে তা হচ্ছে লেক। লেকগুলো হচ্ছেঃ গুলশান-বাড়িধারা, গুলশান-বনানী, ধানমন্ডি, রমনা, ক্রিসেন্ট, হাতিরঝিল, উত্তরা। এসব লেকও দূষণ, দখল, ভরাট ও অব্যবস্থাপনা ফলে নগরবাসী লেক ও লেক কেন্দ্রিক ইকোসিস্টেম থেকে কাঙ্খিত পরিবেশগত সুফল পাচ্ছে না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পাশাপাশি ২০১৩ সালের জুন থেকে নিয়মিতভাবে গুলশান-বারিধারা, গুলশান-বনানী, ধানমন্ডি, রমনা ও ক্রিসেন্ট লেকের পানির গুণাগুণ (পানির দ্রবীভ’ত অক্সিজেন ও পিএইচ) পরীক্ষা এবং দূষণ, দখল ও ভরাট সরেজমিন পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। পবার পর্যবেক্ষণকালে দেখা যায় যে, গুলশান, বারিধারা, বাড্ডা, কালাচানপুর এলাকার গৃহস্থালী বর্জ্য, পুরাতন বিল্ডিংয়ের ভাঙ্গা অংশ, বিল্ডিং মেরামত ও পুনঃসংস্কার থেকে সৃষ্ঠ বর্জ্য লেকে ফেলে গুলশান-বারিধারা লেক ভরাট করা হচ্ছে এবং সেখানে গাছ লাগিয়ে, নার্সারী গড়ে তুলে, চায়ের দোকান দিয়ে, বাশের ঘর ও আধা পাকা ঘর তুলে দখল করা হচ্ছে। করাইল বস্তি এলাকায় গুলশান-বনানী লেক ভরাট ও দখলের মাত্রা সবচেয়ে বেশী এবং সেখানে অনেক কাঁচা লেট্রিন রয়েছে ও বস্তি এলাকার পয়ঃবর্জ্য সরাসরি লেকে ফেলা হচ্ছে। নার্সারী স্থাপনের মাধ্যমেও লেক ভরাট করা হচ্ছে। বনানী, গুলশান, বারিধারা, বাড্ডা, কালাচানপুর এলাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনের কোন ব্যবস্থা নেই। পয়ঃবর্জ্য সেপ্টিক ট্যাংকের মাধ্যমে পরিশোনের নিয়ম থাকলেও এসব এলাকার বাড়ির মালিকগণ তাদের পয়ঃবর্জ্য লেকে ফেলছেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অপরিশোধিত বর্জ্যও লেকে ফেলা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণকালে লেকে প্রচুর পরিমান বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ভাসতে দেখা যায়।

ধানমন্ডি লেকের ৩২নং রোডের ব্রীজ হতে ২৭ নং রোডের সাম্পান পর্যন্ত এলাকায় গৃহস্থালী বর্জ্য, পুরাতন বিল্ডিংয়ের ভাঙ্গা অংশ, বিল্ডিং মেরামত ও পুনঃসংস্কার থেকে সৃষ্ঠ বর্জ্য ফেলে লেক ভরাট করা হচ্ছে। একইভাবে ৩২ নং রোড হতে কলাবাগান মাঠ পর্যন্ত এলাকাও ভরাট করা হচ্ছে। লেকের ভিতরের তিনটি দ্বীপের দোকান, পানশী, সাম্পান, ডিঙ্গি, রবীন্দ্র সরোবরসহ বিভিন্ন খাবার দোকানের বর্জ্য সরাসরি লেকে ফেলা হচ্ছে। লেককেন্দ্রিক পাবলিক টয়লেটসহ সকল খাবার দোকানের পয়ঃবর্জ্য এবং রান্না ঘরে সৃষ্ট ধৌত বর্জ্য লেকে ফেলা হচ্ছে।

রমনা লেকে রমনা রেস্তোরার বর্জ্য এবং পাবলিক টয়লেটের বর্জ্য লেকে ফেলা হচ্ছে। রমনা লেক এবং পার্ক এলাকায় সারাদিন বিশেষ করে সকাল ও বিকাল বেলা অনেক মানুষ হাঁটা-চলা করে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে ব্যাপক জনসমাগম ঘঠে এবং প্রচুর পরিমান বর্জ্য সারা পার্কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এবং লেকেও পড়ে।  ক্রিসেন্ট লেক এবং চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায় সারাদিন বিশেষ করে সকাল ও বিকাল বেলা অনেক মানুষ হাঁটা-চলা করে। জনসাধারণ প্রচুর পরিমান বর্জ্য উদ্যান ও লেকে ফেলে থাকে।

পানি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, গুলশান- বাড়িধারা লেকে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের পরিমান ০.২৫- ৩.৬৬ মিলিগ্রাম। কালাচানপুর ড্রেনের মুখে ০.২৫-০.৯৮, ৭ নং রোড়ের মাথায় ০.৩১-১.১৭, গুলশান ২ (ব্রিজের নিচে) ০.৪৭-২.০০, শাহজাদপুরে ০.৫৭-২.৯৮ মিলিগ্রাম। গুলশান- বনানী লেকে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের পরিমান ০.১৮- ৩.৭৬ মিলিগ্রাম। গুলশান ১, রোড ১ (ব্রীজের নিচে) ০.২৫-১.৪৪, গুলশান-১, রোড-৮ (ড্রেন)  ০.৩৬-২.৪৯, এয়ারটেল অফিসের সামনে ০.২১-২.৪৪, টিভি গেট, ১ নং ঘাট ০.২৭-৩.৬৭ মিলিগ্রাম। গুলশান- বাড়িধারা লেকে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে পিএইচ ৭.৪৬-১০.১৪ এবং গুলশান- বনানী লেকে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে পিএইচ ৭.৪৭-৯.৯৪।

ধানমন্ডি লেকে জুন ২০১৩ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের পরিমান ২.১০- ১০.১৯ মিলিগ্রাম এবং পিএইচ ৭.৫২-৯.৪৪। রমনা লেকে আগষ্ট ২০১৩ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের পরিমান ১.৫২- ৯.৩০ মিলিগ্রাম এবং পিএইচ ৭.২৪-৯.৮২। ক্রিসেন্ট লেকে অক্টোবর ২০১৩ হতে মার্চ ২০১৬  পর্যন্ত সময়ে প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের পরিমান ৩.৯২- ১২.৪৮ মিলিগ্রাম এবং পিএইচ ৭.৬৫-১০.৩০।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ ভ’পৃষ্ঠস্থ পানির মানমাত্রাঃ মৎস চাষে ব্যবহার্য এবং বিনোদনমূলক কার্যে ব্যবহার্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেন ৫ বা তদুর্ধ্ব ও পিএইচ ৬.৫-৮.৫। পানির ভাল গুণগতমানের জন্য পর্যাপ্ত দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের প্রয়োজন। অক্সিজেন সব ধরনের জীবনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। সব জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য দ্রবীভ’ত অক্সিজেন অত্যন্ত অপরিহার্য। প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের মাত্রা ৫মিলিগ্রামের কম হলে জলজ জীবন চাপে পড়ে এবং ৭ মিলিগ্রামের বেশী হলে জলজ জীবন রাতে বিশেষ করে শেষ রাতে চাপে পড়ে । এমাত্রা যত কমতে থাকবে, চাপ তত বাড়তে থাকবে। প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ১-২ মিলিগ্রামের কম হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে মাছ মারা যেতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষার সুপারিশ অনুযায়ী মাছের জীবন ধারনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে কমপক্ষে ৪-৫ মিলিগ্রাম দ্রবীভ’ত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫এর আওতায় গুলশান- বাড়িধারা এবং গুলশান- বনানী লেক দুটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে বিভিন্ন কার্যাবলী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ৫ ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তনে বাধা-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু এ আইনদুটিসহ অন্যান্য আইনের কার্যকর প্রয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

সুপারিশ ঃ
ক্স    ঢাকার লেকগুলোর ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনের উপর ন্যস্ত করা।
ক্স    গুলশান- বারিধারা এবং গুলশান- বনানী লেক ভরাট ও দখলরোধে রাজউক কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং লেকের ভরাট ও দখলকৃত অংশ পুনরুদ্ধার ও নির্মিত স্থাপনা অপসারণ করে লেক পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা।
ক্স    গৃহস্থালী এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য যাতে গুলশান- বাড়িধারা এবং গুলশান- বনানী লেকে ফেলা না হয় সেলক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং কড়াইল বস্তির ঝুলন্ত টয়লেট উচ্ছেদ করা।
ক্স    ধানমন্ডি লেক ভরাট ও দখলরোধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা
ক্স    রমনা লেক, পার্ক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স    ঢাকা মহানগরীর পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্স    শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য যাতে লেকে ফেলা না হয় সেলক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।