জনঘনত্ব, এলাকার পরিধি ও স্লুপ বিবেচনায় ড্রেনেজ ও পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান
স্যুয়ারেজ, ড্রেনেজ লাইনসহ বিদ্যুৎ গ্যাসের নতুন সংযোগ প্রদান ও মেরামতের জন্য সারাবছরই বিশেষ করে বর্ষাকালে রাস্তা খুড়াখুঁড়ি চলতে থাকে। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায় এবং ভারি বর্ষণে শহরের অধিকাংশ এলাকা জলাবদ্ধতায় প্রায় অচল হয়ে যায়। ড্রেনেজ লাইনের সাথে সুয়্যারেজের বর্জ্য মিশে দুর্বিসহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাছাড়া অপ্রতুল পয়:বর্জ্য ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে একদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আনা যাচ্ছে না অপরদিকে সংগৃহীত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণে ঢাকা শহরের ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ বিভিন্ন ধরণের সার্ভিস যেমন গ্যাস, বিদ্যুৎ, সুয়্যারেজ ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ ভৌত অবকাঠামোর ত্রিমাত্রিক নকশা করে তার ভিত্তিতে জনঘনত্ব, এলাকার পরিধি ও স্লুপ বিবেচনায় ড্রেনেজ ও পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা জরুরী। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর উদ্যোগে আজ ০৪ জুলাই ২০১৫, দুপুর ১২টায় পবা কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।


বিদ্যমান সুয়্যারেজ সিস্টেমের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও অপরিকল্পিতভাবে নিত্য নতুন বাসাবাড়ির বর্জ্যরে সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ধারণ ক্ষমতা বিবেচনা না করে নতুন নতুন সংযোগের ফলে অধিকাংশ সময়ই আগের ড্রেনের সাথে নতুন লাইনের সংযোগ ম্যাচ করে না। এছাড়াও দেখা যায় নতুন সংযোগ বা বিদ্যমান লাইন মেরামতের সময় রাস্তা খুড়াখুড়ি করে বর্জ্য রাস্তায়ই রাখছে ফলে শূষ্ক মৌসুমে ধুলা আর বর্ষাকালে কাদা জমে জনদুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। আবার এই লাইন মেরামতও তদারকির অভাবে নিন্মমানের হয়। ফলে দ্রুত আবার ভেঙ্গে যায়। আর পরিস্থিতি সামাল দিতে ওয়াসা কিংবা অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান খন্ড খন্ডভাবে খুড়াখুড়ি চালায়। জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে সমাধান করতে চায়। অথচ এ দুর্বিসহ অবস্থা বিগত দিনের বিবেচনাহীন প্রকল্প ও পরিকল্পনার প্রত্যক্ষ ফসল। তার বিক্ষিপ্ত কোন সমাধান নেই। সমাধান করতে হবে সামগ্রিক বিবেচনায়। 

ইমারত নির্মাণ বিধিমালাও একটি ব্যবসায়িক পক্ষপাতদুষ্ট নীতি। নতুন ইমারত নীতিমালায় জনঘনত্ব বাড়ছে। জনঘনত্ব বাড়ার ফলে পয়:বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও নিত্য দিনের ব্যবহারের জন্য পানির ব্যবহার অনেক বাড়ছে। কিন্তু সেই প্রয়োজনকে মাথায় রেখে পয়:বর্জ্য ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা, পানি নিষ্কাশন, যাতায়াত ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বিবেচনায় বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পুর্ণবিবেচনার দাবী রাখে। 

জনঘনত্ব বিবেচনায় মাস্টারপ্ল্যানের অভাব, ত্রুুটিযুক্ত ডিজাইন ও বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে মহানগরীর ড্রেনেজ ও সুয়্যারেজ ব্যবস্থায় মহাবিপর্যয় ধেয়ে আসছে। অপরিকল্পিতভাবে ইমারত নির্মাণ চলছেই। অথচ জনঘনত্বের সাথে সুয়ারেজের সম্পর্ক রয়েছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কারণে জনসংখ্যা কত হবে তা কেই বলতে পারছে না। যেভাবে সাবসিডি দেয়া হচ্ছে তাতে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। সমস্ত সাবসিডি ঢাকা কেন্দ্রিক হচ্ছে। ঢাকায়ও আবার এলাকাভেদে এই সাবসিডির অনেক তারতম্য হচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ওয়াসার প্রস্তাবিত ব্যয় ছিল  ২০,৮০৯ কোটি টাকা। যেহেতু এটি জনগণের টাকা সুতরাং এই বিশাল অংকের টাকার সুবিধার সুষম বন্টন থাকতে হবে। কেবল বাসা মালিক কিংবা বিশেষ এলাকার সুবিধা বৃদ্ধিতে এই ব্যয় করা হলে তা হবে রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থী এবং অন্যায়। বর্তমান ধারায় ঢাকা কেন্দ্রিক নীতির ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এই গতি অব্যাহত থাকলে মহানগরী ঢাকায় মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। 

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এম এম সফিউল্লাহ, পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, পবার নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু, গ্রীণমাইন্ড সোসাইটির সভাপতি আমির হাসান, ডাব্লিউবিবির ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার মো: মারুফ হোসেন, ২৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলেয়া পারভীন রনজু প্রমুখ। 

ঢাকা ওয়াসার হিসাব মতে মহানগরীতে ঢাকায় প্রতিদিন ১৩ লক্ষ ঘনমিটার পয়:বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। যার মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১২ লক্ষ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর পানির গুণগত মানের অবনতি হচ্ছে। অতি দূষণে নদীর মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে; শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে এবং জীবানুজনিত দূষণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাঘাট, স্যুয়ারেজ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনসহ বিভিন্ন সেবাসমূহের অবকাঠামো তৈরি ও মেরামতে সরকার জনগণের টাকা সরকার ব্যয় করছে। এই সার্ভিসগুলো সরবরাহে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয় সার্ভিসগুলো ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিল হিসেবে তার তুলনায় অত্যন্ত নগন্য পরিমাণ আদায় করা হয়। অতিরিক্ত ব্যয় সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেয়। অথচ এই ভর্তুকি বন্টনে প্রকট বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।

এমতাবস্থায় আমাদের সুপারিশসমূহ-
১.    পানি ও পয়:বর্জ্য নিষ্কাশনের বাঁধাসমূহ দূর করতে ড্রেনের মুখসহ ড্রেন ভালভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে।
২.    পয়:বর্জ্য পরিশোধন না করে নদী, খাল, বিল বা জলাধারে ফেলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা। 
৩.    পয়:বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন কোন আবাসিক এলাকা করার সময় তাদের নিজস্ব পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। নতুন আবাসিক প্রকল্পসমূহে পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই অনুমোদন দিতে হবে। 
৪.    প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকার খাল, নদী, জলাধারগুলো উদ্ধার করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। 
৫.    বৃষ্টির পানি ধারণের ব্যবস্থা রেখে গৃহায়ন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় পরিবর্তন আনা। সেই অনুসারে ইমারত নির্মাণ নীতিমালা সহ অন্যান্য নীতিমালা ও আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা।
৬.    মহানগরীর জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য গ্রাম ও ছোট ছোট শহরগুলোতে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ব্যবস্থা উন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। 
৭.    ঢাকা শহরের ত্রিমাত্রিক (ভূ-গর্ভস্থ, ভূ-উপরিস্থ বিভিন্ন ধরণের সার্ভিস যেমন গ্যাস, বিদ্যুৎ, সুয়্যারেজ ড্রেনেজ ব্যবস্থা,র) নকশা করা।
৮.    ত্রিমাত্রিক নকশার ভিত্তিতে জনঘনত্ব, এলাকার পরিধি ও স্লুপ বিবেচনায় ড্রেনেজ ও পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা। 
৯.    পয়:বর্জ্য নিষ্কাশনে জনঘনত্ব বিবেচনায় পরিধি নির্ধারণ ও স্লুপ নির্ধারণ করা। 
১০.    ঢাকা শহরে কোন সার্ভিসের জন্য এবং কোন এলাকায় কত ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তার এলাকাভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা। উন্নয়ন কর্মকান্ডে কোন খাত থেকে ভর্তূকি প্রদান করা হচ্ছে তা সুনির্দিষ্ট করা।