বাজেট পরিবেশ সংবেদনশীল নয়

এবার বাজেট প্রণেতাদের মূল উদ্দেশ্য স্বল্পস্থায়ী প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি। এখানে পরিবেশ ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের বিষয়টি উপেক্ষিত। অর্থাৎ বাজেঁটি সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনমানের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী এবং গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি উৎকটভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। খাতওয়ারী বিশে¬ষণে দেখা যায় যে বাজেটে পরিবেশ বিষয়টি গত কয়েক বছরের তুলনায় গৌণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি যদিও জলবায়ু তহবিল থেকে বেশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাজেটে বরাদ্দের চেয়ে বেশি দরকার পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা। সামগ্রিকভাবে বলা যায় এবারের প্রস্তাবিত বাজেট পরিবেশ সংবেদনশীল নয়। ১৭ জুন ২০১২, সকাল ১০:৩০ টা, জাতীয় প্রেসক্লাব পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও জনউদ্যোগ এর যৌথভাবে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক থেকে উক্ত অভিমত জানানো হয়। 

জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. এইচ কে আরেফিন এর সভাপতিত্বে বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুুরুল আহসান খান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মলি¬ক, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমদ খান, পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল প্রমূখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন।
 
এবারের বাজেটে ইটিপি স্থাপনে আমদানি শুল্ক স্থাপনে বিশেষ রেয়াত দেওয়া হয়েছে। এতে শিল্পবর্জ্য দুষণরোধে কিছুটা প্রভাব ফেলবে কিন্তু এ পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। বাজেটে প্রণোদনার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ট্যাক্সেরও ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন যদিও সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অমান্য করার জন্য কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিবেশও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির বিবেচনায় তা যৎসামান্য। মানুষের জীবনযাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধি করা। 

বড় বড় নগরীতে বিশেষ করে মহানগরীর যোগাযোগ খাতে বৈষম্য শতবর্ষ পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী বৈষম্যের সাথে তুলনীয়। প্রাইভেটকার না থাকলে ফ্রি মুভমেন্ট প্রায় অসম্ভব, কষ্টদায়ক তো বটেই। একদিকে  প্রাইভেটকার কেন্দ্রিক যোগাযোগ নীতি অপরদিকে অপর্যাপ্ত বাস, ট্রেন ও রিকশা নিয়ন্ত্রণের ফলে গণপরিবহনে চলছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এসব কারণে বাধ্য হয়ে প্রাইভেটকারের সংখ্যা বাড়ছে।  যানজটও পাল¬া দিয়ে বাড়ছে। ফলে দূষণ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের খরচ ও কষ্ট। এতে আরও বাড়ছে বৈষম্য ও জ্বালানি খরচ ও ভর্তুকি। মহানগরীতে ভৌত কাঠামোতে বিশাল বাজেট এতে অবস্থার উন্নতি না হয়ে হবে অবনতি। মহানগরীর পরিবহন খাতে কষ্টদায়ক বৈষম্য গণঅসন্তোষেরও জন্ম দিচ্ছে। যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাজেটে রেল যোগাযোগের উপর গুরুত্ব দিলেও রেল কেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য তা যথেষ্ট নয়। 
ইকোসিস্টেমের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে পানি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত অনেক প্রকল্প সারা দেশের জলাধার কেন্দ্রিক ইকোসিস্টেম বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। নদী খননের জন্য ড্রেজার সংগ্রহ করে বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এতে ইকোসিস্টেম বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কম খরচে নদী খননের বিকল্প বিষয়টিও যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
সঙ্গত কারণেই কৃষি ও গ্রামীণ অবকাঠোমো খাতকে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষিখাত উন্নয়নের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিবেশ বা ইকোসিস্টেমের রক্ষার বিষয়টি যথাযথ বিবেচনায় নেয়া হয়নি। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষনে কিছু প্রকল্প গ্রহণ করলেও সামগ্রিকভাবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। 
মহানগরীসহ সারাদেশের কৃষি জমি ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা জরুরী। ভূমির দাম কমানোর জন্য “প্রত্যেকের জন্য বাসস্থান কারও জন্য একাধিক নয়” এই নীতিকে গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে বাজেটে এর প্রতিফলন প্রয়োজন। 
শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা ছাড়া সারা দেশের পরিবেশ,  ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ অসম্ভব। সে ব্যাপারে উদ্যোগ নাই বললেই চলে।এমনকি কিছু কিছু পদক্ষেপ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। যেমন স্থানীয় সরকারের তহবিল সংগ্রহের জন্য জলাধার ইজারা দেওয়া। এতে পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম ও মৎস সম্পাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। 
সমস্ত উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিবেশ সংবেদনশীল করা প্রয়োজন।  এর জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বেশ কিছু পরিবর্তন এবং সমস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরিবেশ সংবেদনশীল করা। পরিবেশ সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয়ে নজরদারি করতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ন্যায় শক্তিশালী পরিবেশ কমিশন গঠন জরুরী। 
বাজেটে নিন্মোক্ত সুপারিশগুলি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করছি-
১.    পরিবেশ রক্ষা বা উন্নয়নে পৃথকভাবে বরাদ্দের চেয়ে যে কোন উন্নয়নমূলক কাজে পরিবেশ বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও পরিবেশ ধ্বংসকারী কার্যক্রমের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা।
২.    বাজেটে ফ্লাইওভার না করে গণপরিহনের জন্য  বিশেষ বরাদ্দ রাখা
৩.    গাড়ির সিসি অনুসারে আনুপাতিক হারে আমদানী কর ভ্যাট ইত্যাদি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা। পরিবারে একাধিক গাড়ি থাকলে করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। একইভাবে রোড ট্যাক্স বিশগুণ বৃদ্ধি করা। 
৪.    বড় বাসের আমদানি ও পরিচালনা খরচ কমানোর ব্যবস্থা করা উচিত। 
৫.    কৃষি জমি ও জলাধার সংরক্ষণের স্বার্থে বড় ও একাধিক বাড়ি/ফ্ল্যাট/প¬ট ক্রয় ও রাখা নিরুৎসাহিত করার জন্য এলাকা ভিত্তিক ক্রমবর্ধমান হারে কর আরোপ করা। একইসাথে আয়কর বৃদ্ধি করতে হবে।
৬.    ভূমির মূল্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে যেমন হাউজিং নীতিমালা “প্রত্যেকের জন্য বাসস্থান কারও জন্য একাধিক নয়” এই নীতি অনুসারে বাসস্থান ও প¬টের প্রগ্রেসিভ হারে ট্যাক্স নির্ধারণ। 
৭.    হেরিডিটি ট্যাক্স নির্ধারণ করা
৮.    মহানগরীসহ সারাদেশের কৃষি জমি ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা (সুনির্দিষ্ট দাগ ও সীমানাসহ) প্রণয়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ।
৯.    যানজট নিরসনে ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রাইভেটকার কেন্দ্রীক যাতায়াত প্রত্যাহার করে গণযোগাযোগ ব্যবস্থায় আসতে হবে।
১০.    সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ঢালাওভাবে টোল আদায় প্রস্তাব বাতিল করা। 
১১.    নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রধান খরচ সংরক্ষণ বা ব্যাটারীতে সোলার বিদ্যুতের খরচ কমাতে সরাসরি জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহকারীকে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহারের জন্য ব্যাটারী উৎপাদন ও বিপননে প্রণোদনা দেওয়া। 
১২.    জৈব গ্যাস উৎপাদন বিভিন্ন ধরণের প্রণোদনা দেওয়া। 
১৩.    তামাক উৎপাদন ও বিপননে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা 
১৪.    পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া। ভারী/মৌলিক/মেশিনারিজ তৈরি শিল্পে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া।
১৫.    পরিবেশ দূষণকারী শিল্প স্থাপন নিরুসাহিত করতে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতা যেমন ইটিপি তৈরি ও চালু রাখার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির জন্য পৃথক দাম নির্ধারণ।
১৬.     পানি যেহেতু প্রাকৃতিক সম্পদ শিল্পে পানির ব্যবহারের উপর আলাদা করে ট্যাক্স ধার্য করা। যারা বেশি পানি ব্যবহার করবে তার জন্য বেশি কর ধার্য করা। 
১৭.    ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা ও মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার স্থাপনে আইন করে উচ্চহারে কর আরোপ করা। 
১৮.    প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, দোকানপাট, হাসপাতাল, রেলস্টেশন জনসমাগম স্থানে পাবলিক পয়:প্রণালীর জন্য পৃথক বরাদ্দ করতে হবে। 
১৯.    কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় রাসায়নিক ব্যবস্থার পরিবর্তে অর্গানিক কৃষি ব্যবস্থায় উৎসাহিত করে আমাদের প্রাণ বৈচিত্র্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
২০.    রেমিট্যান্স বেশি করে আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা করা। কিন্তু রেমিট্যান্সের টাকা জমি/বিল্ডিং/বাসস্থানে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে বরং পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন খাতে ব্যবহারের প্রণোদনা দেয়া ।
২১.    প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিবর্তন ও সংবেদনশীল করা জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা। বিশেষ করে “পরিবেশ কমিশন” গঠন করা।