স্বাধীন পরিবেশ কমিশন ও পরিবেশ আদালতে জুরি ব্যবস্থা চাই

১৯৯৫ সালে প্রণীত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ সালে সংশোধিত হয়। ২০০০ সালে এই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য পরিবেশ আদালত গঠিত হয়।  কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই আদালত একটি অকার্যকর আদালত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পরিবেশ আইনের সফল বাস্তবায়ন, পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সংশি¬ষ্ঠ সকলের জবাবদিহীতা নিশ্চিত করার স্বার্থে বাংলাদেশে “স্বাধীন পরিবেশ কমিশন” গঠন করা উচিত এবং পরিবেশ আদালতে জুরি ব্যবস্থা চালু জরুরী। ০৩ ফেব্র“ুয়ারী ২০১১ বৃহস্পতিবার, সকাল ১০:৩০ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দালন (পবা) এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে “বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের পরিবেশ আইন ও আদালত সংস্কার ভাবনা” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা উপরোক্ত মতামত দেন। 

আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংক্রান্ত সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান, জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ড. শাহ আলম। নির্ধারিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেলার নির্বাহী পরিচালক, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজান খান, পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জনাব আবদুস সোবহান। সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন  করেন অধ্যাপক এ এন এম ওয়াহিদ। এছাড়াও সংশি¬ষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদগণ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।

বক্তারা বলেন বাংলাদেশে গবেষণা ও জনগণের মতামত গ্রহণ সাপেক্ষে আইন প্রণয়নের ধারা অপ্রচলিত। পরিবেশ আইন সম্পর্কে অসচেতনতা এবং পরিবেশের সূদূর প্রসারী ও স্থায়ী ক্ষতির দিক বিবেচনায় না নিয়ে তাৎক্ষণিক লাভালাভের মনোভাব পরিবেশের উপর নেচিবাচক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া সাধারণভাবে ভূল ধারণা আছে যে, পরিবেশ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সূদূর প্রসারী ক্ষতিকর ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের বিপক্ষে পরিবেশ আইনের সফল প্রয়োগ যে টেকসই উন্নয়নের সহায়ক এই প্রচারণাও অত্যন্ত কম।  অনেক সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সেবার মনোভাবের পরিবর্তে শাসনের মনোভাব এবং জবাবদিহীতার পরিবের্তে স্বেচ্ছাচারীতার মনোভাবও এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অন্তরায়। 

সেমিনার থেকে আইনের এই অন্তরায় এবং পরিবেশ আদালতের অকার্যকারিতার নেপথ্যে কিছু কারণকে চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য কিছু বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে গুরত্ব দেওয়ার মতামত দেন। 

প্রথমত: পরিবেশ আইনের পৃথক ও স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ঠ্য এবং বিজ্ঞানও কারিগরী নির্ভর সাক্ষ্যের নির্ভরতার কারণে পরিবেশ আদালতের স্বতন্ত্র বৈশ্বিক ধারণা থেকে বাংলাদেশের পরিবেশ আদালতের ধারণা একদমই পৃথক।  এক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের পরিবেশ আদালতের মত বিশেষজ্ঞ কমিশনার নিয়োগ করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত: পরিবেশ আদালতের এখতিয়ার সুবিন্যস্ত সমন্বিত ঐক্য একীভূত করা হয়নি। পরিবেশ সংক্রান্ত সকল আইনকে সমন্বিত করে একটি বিস্তৃত আইন প্রনয়ন করা দরককার। তা বিচারের ভার পরিবেশ আদালতের উপর  ন্যস্ত করা জরুরী। নিউজিল্যান্ডে এমনভাবে দুই বৎসরের গবেষণার পর উপনিবেশিক আমল থেকে প্রচলিত সমস্ত পরিবেশ সংক্রান্ত আইন এবং নতুন প্রায় ২৬ টি আইনকে একীভূত করে রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এ্যাক্ট প্রনয়ন করা হয়েছে।

তৃতীয়ত: একই আদালত থেকে সমগ্র পরিবেশগত বিষয়ে সমাধান পাবার লক্ষ্যে এই আতালতের স্টাটাস বাংলাদেশে প্রচলিত। অন্যান্য বিশেষায়িত আদালতের মত কিছুটা উচ্চতর করা যেতে পারে। যেন জুডিশিয়াল রিভিউ সহ সমস্ত মামলা এই আদালতে বিচার করা যায়। এতে পরিবেশগত জুরিসপ্র“ডেন্স সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হবে। এবং আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জিত হবে।

চতুর্থত: পরিবেশ আদালতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যথেচ্চাগমনকে নিশ্চিত করার স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মামলা করার বিধানটি অবিলম্বে তুলে দেওয়া উচিত। 

পঞ্চমত: দক্ষ পরিবেশ আইনজীবি ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অপ্রতুলতার বিসয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে এই জ্ঞান বিস্তারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অধ্যায়নের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত। 

ষষ্ঠত: ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবেশগত ক্ষতির সুদূরপ্রসারী স্থায়ী ক্ষতির বিষয়টি জনগণকে সচেতন করা প্রয়োজন। 

সপ্তমত: পরিবেশ আইন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পরিবেশ আদারতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা প্রয়োজন। 

অষ্টমত: পরিবেশগত মামলায় যেহেতু ব্যক্তিগত লাভালাভের চাইতে সমাজের স্বার্থ বেশি সংরক্ষিত হয় তাই আইনগত সহায়তা আইন ২০০০ কে সংশোধন করে সচেতন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদানের বিধান করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনে পরিবেশগত তথ্য প্রদানের বিষয়ে বিশেষ বিধান করা প্রয়োজন। 

নবমত: পরিবেশ সংক্রান্ত সকল লাইসেন্স বা পারমিট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অথবা এই সব লাইসেন্স বা পারমিটের শর্তাবলী লংঘনের বিষয়ে পরিবেশ আদালতের এখতিয়ার প্রদান করা প্রয়োজন।
 
দশমত: পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি আইনের সফল বাস্তবায়ন ও সংশি¬ষ্ঠ সকলের জবাবদিহীতা নিশ্চিত করার স্বার্থে যুক্তরাজ্য, ত্রিনিদাদ ও টোবাকো, ভূটান বা সিঙ্গাপুরের ন্যায় বাংলাদেশেও স্বাধীন পরিবেশ কমিশন গঠন করা উচিত। 

বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ  আইন ও পরিবেশ আদালত আইন সাম্প্রতিক সংস্কার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি সাধন করলেও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে এর আরও সংস্কার প্রয়োজন। উপরে উলে¬খিত সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশগত সুবিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উ্ন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।