দুর্নীতিগ্রস্ত নীতির জন্য দায়ী ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবে


দুর্নীতিগ্রস্ত নীতির জন্য দায়ী ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানোর দাবী জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ঠ জনেরা। তারা বলেন- সরকারি বেসরকারি দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত নীতির ফলে দেশের পরিবেশ, আর্থসামাজিক উন্নয়ন রাজনীতি আজ বিপর্যস্ত। ১১ মার্চ ২০১৪, সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আয়োজিত দুর্নীতিগ্রস্ত নীতি ও পরিবেশ বিপর্যয় শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। 

পবার চেয়ারম্যান জনাব আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় “দুর্নীতিগ্রস্ত নীতি ও পরিবেশ বিপর্যয় শীর্ষক” মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এ্যাড. হাসান তারিক চৌধুরী। নির্ধারিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ, তেল গ্যাস বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু-মুহাম্মদ, ট্্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখার উজ-জামান ও পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জনাব আসলাম খান।

এ্যাড. হাসান তারিক চৌধুরী তার প্রবন্ধে বলেন, ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মনিটরিং এর মূল কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাজউকের ভ’মিকা আজ বিতর্কিত। আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমে ঢাকা মহানগরী এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বসবাসের অনুপযোগী শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ শহরের ভয়াবহ যানজট বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। কিন্তু কেন ? রাজউক এর দুর্নীতিগ্রস্থ নীতির কারণে মূল কাজ বাদ দিয়ে নিজেই  ডেভেলপারের ভ’মিকা গ্রহণ, সংসদ সদস্য ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য প্লট বরাদ্দের নীতিতে ব্যস্ত থাকা ও অপরিকল্পিত নগর উন্নয়নকে কার্যত নীতি হিসেবে গ্রহণ করার ফলে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর আজ এই দুরাবস্থা। সমস্যার গভীরে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, রাজউক কর্তৃপক্ষ তাদের সমন্ত মনোযোগ ও জনবলের অধিকাংশই নগর উন্নয়নের কাজে ব্যবহার না করে প্লট বিতরণ ও ভবন নির্মাণের কাজে যুক্ত করেছে। যার সঙ্গে রয়েছে সরকার ও সরকারের বাইরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতির নিবিড় যোগাযোগ।

অধ্যাপক এম এম আকাশ তার আলোচনায় বলেন-প্রাথমিক পুঁজি গঠনের দোহাই দিয়ে এক শ্রেণীর লুটেরা ধনিক দেশে দুর্নীতি আশ্রয়ী একটি ধারা শুরু করে। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এই শ্রেণীর ধনিদের প্রাথমিক পুঁজি গঠন সম্পন্ন হয়নি। বরং দুর্নীতিকে আশ্রয় করে এরা গোটা সমাজ ও রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করেছে। যার প্রভাবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশে পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত নিিতর এই ভয়ানক ধারা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা আনতে হবে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। 

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন-রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত নীতি ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার জন্য নীতি প্রণয়ন করে থাকে। যার ফলে ৮০’র দশকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশের পাবলিক সেক্টরকে পঙ্গু করে দিয়ে ঢালাওভাবে প্রাইভেট সেক্টরকে রাষ্ট্রীয় মদদ দেয়া হয়েছে। এই প্রাইভেট সেক্টরই অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ বিধ্বংসী দানবের ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বলেন, এ দেশে গবেষকরা দারিদ্র নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। এখন দরকার ধনিদের নিয়ে গবেষণা। ধনিদের আয় ও আয়ের উৎস নিয়ে গবেষণা করলেই দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের আসল কারণ বেরিয়ে আসবে। দুর্নীতির কারণে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় সিলেটের মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় দেশের ৫বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ধ্বংস করা হয়েছে।  এদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪০বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা হয়েছে। রাষ্ট্রের এসব ব্যর্থতার দায়ভার জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। 

ড. ইফতেখার উজ জামান বলেন, দুর্নীতির এক ধরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রই দুর্নীতিগ্রস্ত নীতি ও দুর্নীতির সহযোগিতে পরিণত হয়েছে। শুধু মাত্র গবেষণা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এর মধ্যদিয়েই দুনীতিগ্রস্ত নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত নীতি ও দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ অনুপার্জিত অর্থই দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ। 

সভাপতির বক্তব্যে আবু নাসের খান বলেন, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর তথাকথিত কাঠামোগত সংস্কার নীতির দোহাই দিয়ে ৮০’র দশকের শেষভাগ থেকেই গণপরিবহনকে অদক্ষতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে দেশের রেল যোগাযোগ সংকোচনের অঘোষিত নীতি চালু করা হয়েছে। দক্ষ গণ পরিবহন ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করে বিপুল পরিমাণ প্রাইভেটকার আমদানিকে নীতিগতভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। একদিকে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের কোন সম্প্রসারণ হয়নি। অন্যদিকে সরকারি গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি না করে প্রাইভেট পরিবহন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় মদদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রী এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি, সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য পর্যাপ্ত দামি ও বড় প্রাইভেট গাড়ি সরবরাহ করে তাদেরকে গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রতি বিমুখ করে তোলা হয়েছে।  তিনি বেসরকারি খাতে ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির সম্পর্কে দুর্নীতি বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলোকে এ বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য আহবান জানান।