বাজেট প্রণয়নে সামগ্রিক ইকোসিস্টেমকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে
পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ঢাকা মহানগরীর মতো সারা বাংলাদেশ মানুষ ও প্রাণীকূলের বসবাস ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা বা পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য বাজেট ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক দূর্যোগপ্রবণ দেশে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে অবশ্যই যে কোন টেকসই উন্নয়ন কৌশলের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান বাজেট ব্যবস্থাপনায় মূলত আর্থিক স্বচ্ছতা এবং ভৌত অবকাঠামোর দিকে নজর রাখা হয়। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে সেই বিবেচনা প্রায় অনুপস্থিত। প্রকল্পের অগ্রাধিকার চিহ্নিত করণ প্রক্রিয়া যথাযথ নয়। প্রকল্প প্রণয়নে প্রাকৃতিক, সামাজিক, আইনী, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ইকোসিস্টেমকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতার ভিত্তিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিভিন্ন উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের/অধিদপ্তরের ‘পরিকল্পনা সেলটি’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর জন্য পরিকল্পনা সেলকে আপগ্রেড করে ‘পরিবেশ, পরিকল্পনা ও মনিটরিং বিভাগ’ করা। আজ ২৮ মে ২০১৫, সকাল ১০:৩০ মিনিটে পবার উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।


বক্তারা বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও ইকোসিস্টেম ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে যুক্ত করে একটি “পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ মহাপরিকল্পনা” প্রণয়ন ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন রোড়ম্যাপ তৈরি করতে হবে। এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হবে। সেজন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সার্বক্ষণিক সমন্বয় সাধন করতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে এ কাজটি করার জন্য সক্ষম করে তোলতে হবে। বিদেশে ট্রেনিং, কনসালটিং ফার্ম দিয়ে এ কাজটি করলে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে না। শুধুমাত্র পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে এই সমন্বয় করা সম্ভব নয়। এই সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে নয় রেভিনিউ বাজেটে এর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্থার নৈরাজ্য দূর করতে ও আগামির পরিবহন ব্যবস্থা বিবেচনায় ‘রেল কেন্দ্রিক সড়ক, নৌ এবং আকাশপথের সমন্বিত মানুষ ও পণ্য পরিবহন মহাপরিকল্পনা’ প্রণয়ন এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন রোড়ম্যাপ তৈরি করতে হবে। রেলের জন্য বিভাগীয় শহর সমূহের সাথে চার লেনের এবং চট্রগ্রামের সাথে আট লেনের ইলেকট্রিক্যাল রেল উন্নয়নের ব্যবস্থা, দেশে প্রয়োজনীয় বগি ও ইঞ্জিন তৈরি এবং মেরামতের ব্যবস্থা অন্তর্ভূক্ত করে বর্তমান রেল মহাপরিকল্পনাটি সংশোধন করতে হবে। এজন্য রেলে পরিকল্পনা সেলটির সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধির ব্যবস্থা ও বাজেটেই থাকা চাই। একই সঙ্গে বাজেটে রেলের বরাদ্দ বৃদ্ধির এবং কার্যক্রমের অগ্রাধিকার চিহ্নিত ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। 

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা: ওয়াজেদুল ইসলাম খান, বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, বিআইডব্লিউটিএর সাবেক পরিচালক এমদাদুল হক বাদশা, পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

গোলটেবিল বৈঠক থেকে অন্যান্য যেসব সুপারিশ করা হয় সেগুলো হল-
এবারের বাজেটে নিন্মলিখিত বিষয়গুলোও বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে-
ক্স    সারা বাংলাদেশের জন্য গ্রাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাসহ এগ্রো ইকোলজিক্যাল জোন সমন্বয়ে “ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনা” করা। 


পৃ. ১
ক্স    সকল মানুষের জন্য তবে বিশেষভাবে নি¤œ আয়ের  মানুষের পরিকল্পনার বলয়ে নিয়ে এসে পরিকল্পনা করা। সারাদেশে পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
ক্স    পানি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করা।
ক্স    সমগ্র বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা  ও তার বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করা।
ক্স    ঢাকা শহরের ভ’-গর্ভস্থ ও ভ’-উপরিস্থ সকল অবকাঠামো ও সম্পদের জন্য ত্রিমাত্রিক মহাপরিকল্পনা করা। অন্য সকল অবকাঠামো ও উন্নয়ন পরিকল্পনা এই মহাপরিকল্পনার ভিত্তিতেই করা। 
ক্স    পরিবেশ বান্ধব শক্তি বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা
ক্স    শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে নয় বিদ্যুৎ শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের  দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
ক্স    বিদেশ ফেরৎ জনগোষ্ঠীকে কিভাবে উপযুক্তভাবে উৎপাদন খাতে কাজে লাগানো যায় তার পরিকল্পনা করা
ক্স    মানবসন্তানকে মানবসম্পদে রূপান্তরের জন্য “মানব সম্পদ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা” করা। 
ক্স    বিজ্ঞান গবেষণা কাউন্সিল যাতে জাতীয়ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় দিক নির্দেশনা দিতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় করে একটি “বিজ্ঞান গবেষণা কমিশন” গঠন করা। গবেষণায় ‘রিভার্স টেকনোলজি’ ইনভেনশনকে প্রাধান্য দেয়া।
ক্স    পরিবেশ দূষণ করেনা সে ধরণের শিল্পসমূহকে নানাভাবে প্রণোদনা দেয়া।
ক্স    রেল ষ্টেশন ও নৌঘাট কেন্দ্রিক কৃষিপণ্যের জন্য হিমাগার ও গোদামের ব্যবস্থা করা।
ক্স    সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত পাবলিক টয়লেট তৈরি ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ যেমন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইত্যাদি
ক্স    সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান, যেগুলো পরিবেশ দূষণ করে তাদেরকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে, কিন্তু যতদিন পরিবেশবান্ধব হয়নি ততদিন ‘পরিবেশ কর’ আরোপ করতে হবে। মুনাফারও একটা অংশ পরিবেশ খাতের ক্ষতিপূরণ হিসাবে আদায় করা যেতে পারে। 
ক্স    নতুন সব শিল্পকারখানা যেগুলো আগামী দিনে গড়ে উঠবে সেগুলোকে পরিবেশবান্ধব নিশ্চিত করতে হবে। ইটিপি নতুন সব কলকারখানায় বাধ্যতামূলক করতে হবে। নইলে শিল্প কারখানার নিবন্ধন/অনুমোদন না দেয়া। 
ক্স    পরিবেশ আদালতকে সক্রিয় করতে হবে। পরিবেশ আদালতে মামলা করা প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি বিষয়ে যেকোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন পরিবেশ আদালতে মামলা করতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা দরকার।  
ক্স    পরিবেশ আইন, জলাধার আইনসহ পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট/সম্পর্কিত আইন লঙ্ঘনের দায়ে ক্ষতিপূরণের হার বৃদ্ধি ও আদায় নিশ্চিত করতে হবে। 
ক্স    কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ক্স    ট্রাফিক প্ল্যানিং বিভাগ জরুরী ভিত্তিতে করতে হবে।
ক্স    পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা ও প্রাইভেটকারকে নিরুৎসাহিত করা। শুধু গণপরিবহনেই স্বল্প মূল্যের গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে। সব ব্যক্তিগত গাড়ির উপর কনজেশন চার্জ এবং আমদানির সময় আলাদাভাবে পরিবেশ কর আরোপ করতে হবে। বাই সাইকেলসহ গণপরিবহন আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। 
ক্স    খাদ্য উৎপাদনের জমিতে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা পাস করা দরকার। কৃষি জমিতে তামাক চাষের উপর পরিবেশ কর আরোপ করা যেতে পারে।