৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হোক জীবন ও পরিবেশবান্ধব

আগামি ৫ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। মানব এবং পরিবেশ উন্নয়নের জন্য এই পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য থাকে উন্নয়ন প্রকল্প। ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে লক্ষ্য অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনার দিকে যেতে হবে। মন্ত্রণালয়সমূহ কোন খাতে কি অর্জন করতে চায় তার লক্ষ্য অর্জনের কর্মপরিকল্পনা করবে। লক্ষ্য অর্জনের পথে আর্থিক দিকটার সাথে সাথে সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের পরিকল্পনা প্রণয়নের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকটি ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্বের সাথে অর্ন্তভ’ক্ত করতে হবে। সর্বোপরি টেকসই উন্নয়নের জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হতে হবে জীবন ও পরিবেশবান্ধব। আজ ১১ জুলাই ২০১৫, শনিবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে ‘প্রণয়নাধীন ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঃ আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। 

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পবার সহ সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম। সভায় বক্তব্য রাখেন বিএমএ এর সাবেক সভাপতি ডা: রশিদ ই মাহবুব, পবার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য শামীম খান টিটো, জনউদ্যোগের সদস্য সচিব তারিক হাসান মিঠুল, নিরুপমা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন এডভোকেট নাজনীন নাহার নিরুপমা, ইউনাইটেড পিপলস ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আলী হাজারী, উইং কমান্ডার (অব:) কামাল, গবেষক সুরাইয়া আক্তার, রুনু আলী প্রমুখ। 

বক্তারা বলেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনায় বর্তমান সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্থানীয় সম্পদ ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোর পদ্ধতি থাকতে হবে। বর্তমানে অনেক মন্ত্রণালয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে। তা মূলত একটি প্রকল্প তালিকা। অনেক প্রকল্প পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে তৈরি হয়। আবার  অনেক প্রকল্প উন্নয়ন সহযোগীদের প্রভাবে, রাজনৈতিক বা অন্য বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়। প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ের ‘‘পরিকল্পনা সেল’’। ছোট ছোট প্রকল্পের প্রস্তাবনাসমূহ তারা তৈরি করে। বড় প্রকল্প সমূহের পিপি পরামর্শক কর্তৃক তৈরি করা হয়। বর্তমান প্রক্রিয়ায় দুই ক্ষেত্রেই প্রকল্প তৈরিতে মন্ত্রণালয় বা সংস্থার প্রকৃত অংশগ্রহণ খুব একটা হয় না। গাড়ি, ট্রেনিং, বিদেশযাত্রা, কম্পিউটার ইত্যাদি নানা সুযোগসুবিধাদি কি রকম আছে সে বিষয়টি প্রকল্প প্রণয়ণে অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে এ সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভাগ বন্টনে বেশ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের আর্থিক দিকটা খুবই গুরুত্ব পায়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন কোন গুরুত্বই পায় না। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বা বাস্তবায়নের পরে সামাজিক ও পরিবেশগত ঘাত প্রতিঘাতসমূহ বিবেচনার কোন ব্যবস্থাই নাই। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন সময়েই কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া যায় না। 

আমাদের সুপারিশ-
১.    কাঙ্খিত ফলাফল পেতে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়সহ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। 
১.    মহাপরিকল্পনা জাতীয়ভাবে আলোচনা বা তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে হবে। এখানে কারিগরী বিবেচনা যথাযোগ্য পর্যায়ে অবশ্যই হতে হবে। কর্মপরিকল্পনা আন্ত:মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। 
২.    সকল মানুষের জন্য তবে বিশেষভাবে নি¤œ আয়ের  মানুষের পরিকল্পনার বলয়ে নিয়ে এসে পরিকল্পনা করা।
৩.    পানি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করা।
৪.    সমগ্র বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা  ও তার বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করা।
৫.    ঢাকার ভ’-গর্ভস্থ ও ভ’-উপরিস্থ সকল সম্পদের ম্যাপ প্রণয়ন ও অবকাঠামো এবং সেবাসমূহের ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনা করা।
৬.    পরিবেশবান্ধব শক্তি বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৭.    উৎপাদন খাতে বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারে নজর দেয়া।
৮.    বিদেশ ফেরৎ জনগোষ্ঠীকে কিভাবে উপযুক্তভাবে উৎপাদন খাতে কাজে লাগানো যায় তার পরিকল্পনা করা।
৯.    দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা অর্থাৎ মানবসম্পদ উন্নয়ন, সন্তানকে মানব সম্পদে পরিনত করা যায়।
১০.    গবেষণায় ‘রিভার্স টেকনোলজি’ ইনভেনশনকে প্রাধান্য দেয়া।
১১.    পরিবেশ দূষণ করেনা সে ধরণের শিল্পসমূহকে নানাভাবে প্রণোদনা দেয়া।
১২.    সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত পাবলিক টয়লেট তৈরি ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ যেমন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইত্যাদি
১৩.    সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান, যেগুলো পরিবেশ দূষণ করে তাদেরকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে, কিন্তু যতদিন পরিবেশবান্ধব হয়নি ততদিন ‘পরিবেশ কর’ আরোপ করতে হবে। মুনাফারও একটা অংশ পরিবেশ খাতের ক্ষতিপূরণ হিসাবে আদায় করা যেতে পারে। 
১৪.    নতুন সব শিল্পকারখানা যেগুলো আগামী দিনে গড়ে উঠবে সেগুলোকে পরিবেশবান্ধব নিশ্চিত করতে হবে। ইটিপি নতুন সব কলকারখানায় বাধ্যতামূলক করতে হবে। নইলে শিল্প কারখানার নিবন্ধন/অনুমোদন না দেয়া। 
১৫.    পরিবেশ আদালতকে সক্রিয় করতে হবে। পরিবেশ আদালতে মামলা করা প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি বিষয়ে যেকোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন পরিবেশ আদালতে মামলা করতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা দরকার।  
১৬.    পরিবেশ আইন, জলাধার আইনসহ পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট/সম্পর্কিত আইন লঙ্ঘনের দায়ে ক্ষতিপূরণের হার বৃদ্ধি ও আদায় নিশ্চিত করতে হবে। 
১৭.    ট্রাফিক প্ল্যানিং বিভাগ জরুরী ভিত্তিতে করতে হবে।
১৮.    পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা ও প্রাইভেটকারকে নিরুৎসাহিত করা। শুধু গণপরিবহনেই স্বল্প মূল্যের গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে। সব ব্যক্তিগত গাড়ির উপর কনজেশন চার্জ এবং আমদানির সময় আলাদাভাবে পরিবেশ কর আরোপ করতে হবে। বাই সাইকেলসহ গণপরিবহন আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। 
১৯.    শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পরিবেশ খাতকে পরিকল্পনায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে ঘোষণা করা।
২০.    নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক। সকল ধরণের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হোক। 
২১.    পাহাড়, বন, নদী, জলাশয়, পুকুর এগুলোকে সব ধরণের দখলমুখÍ এবং দূষণমুক্ত করা ও জীববৈচিত্র রক্ষার বিষয়টি পঞ্চাবার্ষিক পরিকল্পনার অর্ন্তভ’ক্ত করা।
২২.    কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২৩.    শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, ভ’মি দূষণ প্রতিরোধে শূণ্য সহনশীলতার বিষয়টি নিশ্চিত করা।