খাদ্য আন্দোলন সময়োপযোগী বিশুদ্ধ খাদ্য আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে উপযুক্ত সংস্থা জরুরী

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে সব ধরণের খাবারে ভেজাল ও বিষের মিশ্রণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। শাক-সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, সব ধরণের ফলমূল এমনকি শিশুদের খাবারেও পাওয়া যাচ্ছে স্বাস্থ্যহানিকর নানা রাসায়নিকের মিশ্রণ। সরকারিভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও জরিমানা করলেও কোনভাবেই খাদ্যে ভেজাল ও বিষের ব্যাপকতা রোধ করা যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি বিবেচনায় এবং খাদ্যের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী এ নীরব ধীর গণহত্যা বন্ধে অবিলম্বে সময়োপযোগী বিশুদ্ধ খাদ্য আইন প্রণয়ন ও আইন  বাস্তবায়নে শক্তিশালী একক সংস্থা গঠন জরুরী। আজ ১৮ নভেম্বর ২০১২, রবিবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউন্সে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত “বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতা ঃ সাম্প্রতিক পদক্ষেপসমূহ ঃ আমাদের করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক থেকে উক্ত অভিমত জানানো হয়। 

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড. এম শাহ আলম, বিএমএ এর সাবেক সভাপতি ডা: রশিদ ই মাহবুব, ম্যাজিষ্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা, হেলথ এন্ড হোপ এর পরিচালক ডা: লেলিন  চৌধুরী, পবার সম্পাদক আসলাম খান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জনাব আব্দুস সোবহান।

গোলটেবিল বৈঠকে বিষাক্ত খাদ্যের ক্ষতিকর দিকসমূহ তুলে ধরে বলা হয়- মাছ, ফল, মাংস, এবং দুধে ফরমালিন প্রয়োগের ফলে গলায় ক্যান্সার, রক্ত ক্যান্সার, বাল্য হাঁপানি, এবং চর্ম রোগ হয়। ফরমালিনযুক্ত খাবার মানুষের পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি, অস্থিমজ্জা জমে যায়। এর ফলে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। খাদ্য সামগ্রীতে বিদ্যমান বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ শিশুদের মানসিক এবং শারীরিক বৃদ্ধি এবং মহিলাদের সন্তান ধারনে মারাত্বক প্রভাব ফেলছে, ক্যান্সার হচেছ, মানব দেহের অপরিহার্য অঙ্গ যেমন লিভার, কিডনি এবং হৃদপিন্ড ক্ষতিগ্রস্থ হচেছ। কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল নার্ভাস সিস্টেমের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কার্বাইড থেকে উৎপন্ন অ্যাসিটিলিন ব্রেনে অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করে। তীব্র পর্যায়ে এটা মাথাব্যথা, ঘূর্ণিরোগ, মাথা ঘোরা, প্রলাপ, বাজেয়াপ্তকরণ এবং এমনকি কোমার কারণ। দীঘ মেয়াদে এটা মেজাজ ঝামেলা এবং স্মরণশক্তির ক্ষতি  তৈরি করতে পারে। এটা গ্রহণের পরপরই পেটে ব্যথা, বমি ও পাতলা পায়খানা হতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ফলে কিডনি, লিভার, ত্বক, মূত্রস্থলী, ত্রবং ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে। বার্লি, রুটি, এবং আটায় ব্যবহৃত রাই ময়দা সহিংস আলোড়ন ও গর্ভপাত ঘটায়। ফুলকপিতে ব্যবহৃত হরমন মহিলাদের বন্ধ্যত্ব ঘটায়। চায়নিজ রেস্টুরেন্টের খাবার সামগ্রীতে ব্যবহৃত অ্যাগিনো মোটো বা মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেন্ট নার্ভাস সিস্টেমে গোলমাল এবং বিষাদগ্রস্ততা ঘটায়। চালে ব্যবহৃত ইউরিয়া নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত এবং শ্বাসপ্রশ্বাস সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি করে। দুধ ঘনীভবন/সংক্ষেপণের জন্য ব্যবহৃত সালফিউরিক এসিড কাডিঅ্যাক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইউরিয়া কিডনির জন্য বিপদজনক। বিভিন্ন কারণে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোক কিডনি রোগে ভুগছে। 
অতিরিক্ত এবং অনুমোদনবিহীন কীটনাশক প্রয়োগে খাদ্য দূষিত হয়। শিল্প দূষণের ফলে মাটি, বায়ু ও পানি দূষিত হয়ে খাদ্যশস্য, শাকসবজি, এবং মাছ দূষিত করছে। ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ, বাজার সম্প্রসারণ, এবং ভোক্তার উচ্চ চাহিদার কারণে খাদ্যে ভেজাল ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত লোভ এবং নৈতিক অবক্ষয়ই আজকের এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। খাদ্যে ভেজাল দেয়া গুরুতর ক্রিমিনাল অপরাধ। ভেজাল খাদ্য, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত হুমকি স্বরূপ।

বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে গোলটেবিল বৈঠক থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশসমূহ করা হয়-
১.    খাদ্যে বিষ ও ভেজালের ব্যাপকতারোধে একক সংস্থা স্থাপন ।
২.    খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মিশানোর সাথে জড়িত ও ফরমালিনযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদানই যথেষ্ট নয়। এদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা। এই আইনের ২৫-গ ধারায় খাদ্যে ভেজাল দেয়ার জন্য কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল খাবার বিক্রয়ের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা।
৩.    যেসব শিল্পে ফরমালিনের প্রয়োজন, শুধু তাদেরই লাইসেন্স দেয়া।
৪.    কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারকে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫.    খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে কড়া বাজার মনিটরিং এবং আইন কার্যকরীকরণ নিশ্চিত করা।
৬.    ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ফরমালিনের বিষয়ে সচেতন করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া।
৭.    পরিদর্শন ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনায় সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের সাধন।
৮.    যে কোন খাদ্য সামগ্রীর বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ট্রেড লাইসেন্সের পাশাপাশি খাদ্যের যথার্থতা পরীক্ষা করবে
৯.    ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করার জন্য আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন
১০.    সরকারিভাবে বাজারগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ ।
১১.    এফবিসিসিআই’র নেয়া ব্যবস্থা চালু রাখা ।
১২.    বিভিন্ন আইনের আওতায় প্রণীত খাদ্য পণ্যের জাতীয় মান এবং পণ্যের গুনগত মান একই হওয়া প্রয়োজন।