প্রস্তাবিত ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ খাদ্য আইন-এ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হোক

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে সব ধরণের খাবারে ভেজাল ও বিষের মিশ্রণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। শাক-সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, সব ধরণের ফলমূল এমনকি শিশুদের খাবারেও পাওয়া যাচ্ছে স্বাস্থ্যহানিকর নানা রাসায়নিকের মিশ্রণ। সরকারিভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও জরিমানা করলেও কোনভাবেই খাদ্যে ভেজাল ও বিষের ব্যাপকতা রোধ করা যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি বিবেচনায় এবং খাদ্যের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী এ নীরব ধীর গণহত্যা বন্ধে অবিলম্বে সময়োপযোগী বিশুদ্ধ খাদ্য আইন প্রণয়ন ও আইন  বাস্তবায়নে শক্তিশালী একক সংস্থা গঠনের জন্য পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা-সহ পরিবেশ ও মানবাধিকারবাদীদের দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আজ ০২ মার্চ ২০১২, শনিবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউন্সে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর উদ্যোগে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আইন দুটিতে ফরমালিনযুক্ত এবং বিষাক্ত খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

মূল প্রবন্ধে প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান বলেন, কেবল সচেতনতা দিয়েই সমাজের এই অন্যায়কে ঠেকানো যাবে না, সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য। আর সেটা হতে হবে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে, সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করে এবং আইনের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং কয়েকটি বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার মাধ্যমে কিছুটা ইতিবাচক ফল পাওয়া গেলেও বিষমুক্ত নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নানা ধরণের বিষাক্ত ও নিন্ম মানের খাদ্যের কারণে আগামি প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ খাবারের মধ্যে প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয় যেমন রয়েছে, তেমনি আছে শাক সবজি ফলমূল, মাছ দুধ মিষ্টি।

প্রস্তাবিত ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন, কমিটির দায়িত্ব ও কর্তৃব্য এবং লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ এর বিধান রয়েছে। আইনে জাতীয় কমিটি গঠনের বিধান নেই। প্রস্তাবিত নিরাপদ খাদ্য আইনের আওতায় জাতীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা উপদেষ্টা কাউন্সিল, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কার্যাবলী, কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি, বৈজ্ঞানিক প্যানেল গঠন, খাদ্য দূষণ সম্পর্কিত সাধারণ শর্তাবলী, খাদ্য দ্রব্যের ব্যবসায়ীদের বিশেষ দায়িত্বসমূহ, খাদ্য বিশ্লেষণ ও পরিবীক্ষণ, পরিদর্শন ও খাদ্য দ্রব্য জব্দ করণ, অপরাধ ও দণ্ড এবং বিচারের বিধান রয়েছে। বিদ্যমান আইনসমূহের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির যে বিধান রয়েছে এই আইন দুটি বলবৎ হলে শাস্তির দণ্ড হ্রাস পাবে। যা পরিবেশবাদী, মানবাধিকারবাদী, ভোক্তাদের আকাঙ্খার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। উপরন্তু এ আইন বলবৎ হলে মামলাকারী হয়রানির শিকার হবে এবং মামলা করতে নিরুৎসাহিত হবে। 

ডা: লেলিন চৌধুরী বলেন, ভেজাল খাদ্যে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। কিছু খাবার এমনি বিষাক্ত যে তা ডিএনএকে বদলে দিতে পারে। ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথেফেন এবং সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহৃত হয়। এসবের প্রভাবে শিশুদের ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি ও লিভার পচে যাওয়া, রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হওয়া অন্ধ হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা হতে পারে। খাদ্যের পুষ্টিমান ২০-৪০% কমে যায়। বিষাক্ত খাদ্যের মাধ্যমে ধীর নিরব গণহত্যা চলছে।


ড. এম শাহ আলম বলেন, আইন দুটি সময়োপযোগী তবে এতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্ধন, পরিবর্তন করে কার্যকর করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইন কমিশনের পক্ষ থেকে কার্যকর সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

আবু নাসের খান বলেন, নিরাপদ খাবার তৈরি, বিপনন ও বিক্রি এবং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কটি আইন রয়েছে; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬, বিএসটিআই (সংশোধিত) আইন, ২০০৩, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫, বিশুদ্ধ খাদ্য (সংশোধিত) আইন, ২০০৫, মোবাইল কোর্ট অর্ডিনেন্স ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯। কিন্তু এসব আইনের যথাযথ ও সমন্বিত প্রয়োগ না থাকায় একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠনসহ সমন্বিত আইন প্রণয়ন সময়ের দাবী।

এডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মহামান্য হাইকোর্ট ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করেছেন : অপরাধীদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান, আমদানি পর্যায়ে এনবিআর ্কর্তৃক খাদ্যের বিশুদ্ধতা পরিক্ষাকরণ, স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত ও গবেষণা স্থাপন এবং ফুড এনালিস্ট নিয়োগ করা। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি। 

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. এম শাহ আলম, হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশ এর সভাপতি এডভোকেট মনজিল মোরসেদ, হেলথ এন্ড হোপ এর পরিচালক ডা: লেলিন  চৌধুরী, ডিসিসি দক্ষিণের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মমর্তা ড. আবু সাদাত মোহাম্মদ সালেহ, শাহ আলি মার্কেট কমিটির সম্পাদক হাজী মো: আতিকুর রহমান, টাউন হল বাজার কমিটির দপ্তর সম্পাদক মো: মজিবুর রহমান, অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান, কবি লিলি হক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সম্পাদক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান।

আইন দুটিকে বাস্তবতার নিরিখে সময়োপযোগী  করার লক্ষ্যে গোলটেবিল বৈঠক থেকে নিন্মোক্ত সুপারিশ করা হয়-
১.    প্রস্তাবিত ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-এ উৎসে ফরমালিন ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকা অর্থ দন্ডের বিধান রাখা; অপরাধীর লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল করা। 
২.    প্রস্তাবিত নিরাপদ খাদ্য আইন-এ সর্বোচ্চ শাস্তি এবং অর্থ দন্ডের বিধান রাখা; উপদেষ্টা কাউন্সিল ও ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠনের ৩ জন প্রতিনিধি অর্ন্তভ’ক্ত করা; নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোন আদালত কোন মামলা বিচারার্থে আমলে গ্রহণ করিবে না-এই ধারা বাতিল করা; অভিযোগকারীর শাস্তির বিধান বাতিল করা; মাছ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দায় হতে অব্যাহতির বিধান বাতিল করা।

এছাড়াও 
৩.    আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক ফরমালিন পরীক্ষা করা 
৪.    প্রস্তাবিত ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে ফরমালিন ব্যবহারে জবাবদিহিতা, নির্ধারিত লাইসেন্সের মাধ্যমে বিক্রি, অপব্যবহার ও অবৈধ বহনকারীকে শাস্তির বিধান রেখে এসআরও জারি করা
৫.    কোথায় কি পরিমাণ ফরমালিনের প্রয়োজন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা নিরুপণ করে শুধুমাত্র ঐ পরিমাণ আমদানির অনুমতি প্রদান করা এবং অবৈধপথে যাতে না আসতে পারে সেলক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা
৬.    প্রস্তাবিত ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান আইনসমূহের যথাযথ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা।
৭.    গণমাধ্যমকে খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে যাচাই বাচাইসহ সতর্কতা অবলম্বন করা