আইন প্রয়োগের দূর্বলতা এবং জনসচেতনতার অভাবই শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধি-বিধান থাকলেও সেগুলোর কোন প্রয়োগ না থাকায় রাজধানীতে শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে জনগণের অচেতনতা ও অবহেলাও শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। আইন প্রয়োগের দূর্বলতা এবং জনসচেতনতার অভাবই শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌছেছে।
৩১ জানুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, সকাল ১১ টায়, পবা মিলনায়তনে ঢাকা মহানগরীতে শব্দ দূষণের বর্তমান চিত্র ও করনীয়-শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উঠে আসে।
 
পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পবা’র সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বিসিএইচআরডি-এর সভাপতি মাহবুবুল হক, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-এর প্রকল্প কর্মকর্তা আতিকুর রহমান, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ-এর উপদেষ্টা মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ প্রমুখ। 
 
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সে আর স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পায় না। শব্দদূষণের কুফল বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব এবং শব্দদূষণ প্রতিরোধে যথাযথ প্রশাসনিক নজরদারী ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। 
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, 'শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, এসব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না। নীরব এলাকা হচ্ছে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ইত্যাদি এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ণ বাজানো এবং মোটর, নৌ বা অন্য কোন যানে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী হর্ণ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রনে আইন ও বিধি-বিধান থাকলেও সেগুলোর কোন প্রয়োগ না থাকায় রাজধানীতে শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, 'শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর ন্যস্ত আইনসিদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করা এবং বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং সেই সাথে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা প্রয়োজন। 
এছাড়াও সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প বা মিশ্র এলাকা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করাও জোর দাবি জানান আবদুস সোবহান।
 
শব্দ দূষণের ফলে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা ঘটতে পারে। উচ্চ শব্দ শিশু,  গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘœ ঘটায়। এছাড়াও শ্রবণশক্তি কমে আসে, বধির হওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়, মাথা ব্যথা, বদহজম, অনিদ্রা, মনসংযোগ কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিবোধ, এমনকি অস্বাভাবিক আচরণ করার মত মনোদৈহিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ বিকট শব্দ যেমন যানবাহনের তীব্র হর্ণ বা পটকা ফাটার আওয়াজ মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রচন্ড চাপ দেয়। এধরনের শব্দের প্রভাবে সাময়িকভাবে রক্ত প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি হয়, রক্তনালী সংকুচিত হয়, রক্তে কোলেষ্টেরলের মাএা বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ণ মোটরযানের চালককে বেপরোয়া ও দ্রুত গতিতে যান চালাতে উৎসাহিত করে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) জানুয়ারি ২০১৭ মাসে ঢাকা মহানগরীর ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ  করে। স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এয়ারপোর্ট, কুড়িল বিশ্ব রোড, মহাখালী, ফার্মগেট, বাংলামটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, আজিমপুর, নিউ মার্কেট, সাইন্স ল্যাব, কলাবাগান, ধানমন্ডি, পান্থপথ, ধানমন্ডি ২৭, কলেজ গেইট, শ্যামলী, টেকনিক্যাল, মিরপুর। জরিপকৃত স্থানগুলো নীরব, আবাসিক, মিশ্র ও বাণিজ্যিক এলাকা। নীরব এলাকায় দিবাকালীন, আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন ও রাত্রিকালীন, মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন ও রাত্রিকালীন এবং বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন সময়ে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এছাড়া বাসের ভিতর সামনে ও পিছনে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
 
নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৩.৩ থেকে ১০৪.৪ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন ৯২.২ থেকে ৯৭.৮ ডেসিবল এবং রাত্রিকালীন ৬৮.৭ থেকে ৮৩.৬ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন ৮৫.৭ থেকে ১০৫.৫ ডেসিবল এবং রাত্রিকালীন ৮৫.৭ থেকে ১০৬.৪ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৯৪.৩ থেকে ১০৮.১ ডেসিবল। বাসের ভিতর শব্দের মাত্রা সামনে ৯৩.৬ থেকে ৯৫.২ ডেসিবল ও পিছনে ৮৪.৬ থেকে ৮৫.৪ ডেসিবল। বাংলামটরে এ্যাম্বুলেন্স এর সাইরেন বাজানোকালে শব্দের মাত্রা ১১০.১ ডেসিবল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শব্দের মাত্রা ৯৫.৮ থেকে ৯৬.৭ডেসিবল।
 
নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণেরও বেশী। আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণেরও বেশী। আবাসিক এলাকায় রাত্রিকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে প্রায় দুই গুণের বেশী। মিশ্রএলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণেরও বেশী। মিশ্রএলাকায় রাত্রিকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণেরও বেশী। বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশী। নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ইডেন মহিলা কলেজের সামনে যা ১০৪.৪ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি পল্টনে যা ১০৫.৫ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় রাত্রিকালীন শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি কলাবাগানে যা ১০৬.৪ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি এয়ারপোর্টের সামনে যা ১০৮.৯ ডেসিবল।
 
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়  
১. শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।
২. উচ্চ শব্দসৃষ্টিকারী হর্ন ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। উচ্চ শব্দের হর্ণ আমদানী বন্ধ করা।
৩. নীরব এলাকায় হর্ণ না বাজানো ও অন্যান্য এলাকায় অপ্রয়োজনে হর্ণ না বাজানোর জন্য মোটরযান ড্রাইভারদের উদ্বুদ্ধ করা।
৪. যানবাহন নিয়মিত মেরামত করা।
৫. লাউড স্পীকারের ব্যবহারে সচেতন হওয়া। অডিও ক্যাসেটের দোকানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো নিয়ন্ত্রণ করা।
কলকারখানায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৭. পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর ন্যস্ত আইনসিদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করা এবং বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। 
৮. মোবাইল কোর্ট পরিচালনা।
৯. সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প বা মিশ্র এলাকা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করা।
১০. সর্বোপরি জনগণসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সরকারী বিধিবিধান মেনে চলা।