কোরবানির বর্জ্যরে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবান্ধব ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে

কোরবানির বর্জ্যরে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবান্ধব ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে

সারা দেশে বছরে যে পরিমাণ পশু জবাই করা হয় তার প্রায় ৫০ ভাগ কোরবানির ঈদে জবাই হয়। জবাইকৃত পশুর বর্জ্য-রক্ত, নাড়িভুড়ি, গোবর, হাড়, খুর, শিং সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনার অভাবে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। পরিবেশসম্মত কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা হলে একদিকে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা, অন্যদিকে জবাইকৃত পশুর ঊচ্ছিষ্ঠাংশসমূহ সম্পদে পরিনত করা সম্ভব হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর উদ্যোগে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শনিবার, সকাল ১১টায় পরিবেশ মিলনায়তনে ‘কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ২০১৬ - একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধে আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, মো: সেলিম, সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়-পবিত্র মক্কায় কোরবানি ও পশু জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে রয়েছে। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী পশু কোরবানি করা হয়। এর ফলে দুর্গন্ধ ছড়ানো, রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটা, পশুর চামড়া বিনষ্ট, বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। পশুর চামড়া অত্যন্ত দামী ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিধায় দক্ষ হাতে চামড়া ছাড়ানো হলে এর অযথা ক্ষতি এড়ানো যায়। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে কোরবানি হলে পশুর মাংস ময়লা ও জীবানুযুক্ত হবে না এবং পশুর রক্ত, গোবর, নাড়িভুড়ি, হাড় ও অন্যান্য উচ্ছিষ্টাংশ সার, বোতাম, চিরুণী, মৎস খাদ্য, পশু খাদ্যসহ বেশ কিছু শিল্পে ব্যবহার করা যাবে।

পরিবেশসম্মত কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০১৫ সালের কোরবানির ঈদে ঢাকা মহানগরীর ৩৯৩ টি স্থানকে কোরবানির জন্য নির্ধারিত করে। তবে জনগণ এ ঊদ্যোগে তেমন সাড়া দেয়নি। ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য ১১টি সিটি করপোরেশন (২,৯৪৩টি) ও ৫৩ জেলা শহরে ( ৩,২৯০টি) ৬ হাজার ২৩৩টি স্থান নির্ধারণ করে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ৫৮৩টি এবং উত্তরে ৫৬৭টি। কোরবানির পশুর বর্জ্য দ্রুত অপসারণ ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতে এসব স্থান নির্ধারণ করা হয়।

বাংলাদেশ হাউড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে এবছর সারা দেশে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে গরু ৪০ লাখের বেশি এবং ছাগল, ভেড়া ও মহিষ ৭০ লাখের বেশি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২ লাখ ৪০ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে। কোরবানির জন্য নির্ধারিত ৫০৪টি স্থানে পশু জবাইয়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। দক্ষিণের মাননীয় মেয়রের মতে নির্ধারিত জায়গায় পশু কোরবানির উদ্যোগের দ্বিতীয় বছর চলছে। গত বছরের তুলনায় এবার উপস্থিতি বেশি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে প্রায় শতভাগ বর্জ্য যা ১৯ হাজার টনেরও বেশি অপসারণে সমর্থ হয়েছেন বলে জানান।

এবারের ঈদে নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই করা, গর্ত খুঁড়ে কোরবানির পশু রক্ত পুঁতে ফেলা এবং কোরবানির অযোগ্য, অসুস্থ ও ত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি না দেয়ার জন্য জনসাধারণকে উদ্ধুদ্ধ করতে গণমাধ্যম, পরিবেশবাদী সংগঠন, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, মসজিদের ইমাম, পরিবেশ অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে। যা সারা দেশে ব্যাপক আড়োলন সৃষ্টি করে। এধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে পরিবেশসম্মত কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা সম্ভব হবে।

আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া পশু হাড় থেকে শুরু করে শিং, অন্ডকোষ, নাড়ি-ভ’ড়ি, মূত্রথলি, চর্বি বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হাড় বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, জবাইয়ের পর গরুর আকার ভেদে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। এই হাড় সংগ্রহ করে প্রতিদিন ব্যবসা হয় অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার। হাড় দিয়ে ওষুধ, সিরামিক পণ্যসামগ্রী, বোতাম ও ঘর সাজানোর উপকরণ তৈরি করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় নাড়ি-ভ’ড়ি। ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বড় আকারের পশুর এসব হাড় রফতানি করে শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। চীন ও থাইল্যান্ডে এসব হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। শুধু অসচেতনতা আর অবহেলার কারণে কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে হাড়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুধু কোরবানির গরুর হাড়ের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। কোরবানিসহ সারা বছর জবাইকৃত গরুর হাড়ের মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা

সুপারিশ ঃ
কোরবানির সাথে কোরবানির পশু, কোরবানির পশুর হাট এবং কোরবানির পশু জবাইয়ের বিষয় জড়িত। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নি¤œবর্ণিত সুপারিশ করা হলো -
ক্স ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে এবং সুস্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে সুনির্দিস্ট স্থানে কোরবানির পশু জবাই করতে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করা।
ক্স গর্ত খুঁড়ে কোরবানির পশুর রক্ত পুঁতে ফেলা এবং কোরবানির অযোগ্য, অসুস্থ ও ত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি না দেয়ার জন্য জনসাধারণকে উদ্ধুদ্ধ করা।
ক্স পশু হাড় থেকে শুরু করে শিং, অন্ডকোষ, নাড়ি-ভ’ড়ি, মূত্রথলি, চবি ইত্যাদি সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা এবং আর্থিক প্রনোদনা প্রদান করা। ফলে একদিকে পরিবেশ উন্নত হবে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
ক্স কোরবানির পশুর গোবর এবং পাকস্থলীর অহজমকৃত বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। একইভাবে হাটের গোবর, উচ্ছিষ্ট গোখাদ্য সার্বক্ষণিক সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। সংগৃহীত এসব বর্জ্য জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
ক্স ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে মোটাতাজাকৃত বা রোগাক্রান্ত আমদানিকৃত কোরবানীর পশু সনাক্ত করার জন্য প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরকে সক্রিয় ভ’মিকা পালন করতে হবে।
ক্স পরিবেশসম্মত আধুনিক কসাইখানায় পশু জবাই করা। কসাইখানায় বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।