পবার ওয়েব সাইট উন্নয়নের কাজ চলছে

নিমতলীর বা টাম্পাকোর মতো ভয়াবহ অগ্নিকা- সহ অহরহ সংগঠিত দুর্ঘটনা রোধে আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম, কারখানা ও দোকান অপসারন এবং সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে কেমিক্যাল ও বয়লার ব্যবহার নিরাপদ করতে সরকারের সংশিষ্ট দফতর সমূহের কার্যকর পদক্ষেপের সময় নির্দিষ্ট মহাপরিকল্পনা বা রোড ম্যাপ দরকার। আজ সকালে পবা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত “কেমিক্যাল বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-: নিমতলী থেকে টাম্পাকো - টনক নড়বে কবে?” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এ দাবি জানান।

সম্মানিত বিশেষ অতিথি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, দেশে সংগঠিত দ্রুত শিল্পায়নকে টেকসই এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ লক্ষ্যে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা- রোধে পরিবেশসহ সংশিষ্ট আইন সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী।

 


পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সাধারন সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান এবং অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সম্মানিত অতিথি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, মর্ডান ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পবার সদস্য দিনা খাদিজা, মো. হাবিব প্রমুখ।


২০১০ সালে ৩ জুন নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণে ১২৪ জনের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্ঘটনার পর পর সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈধ ও অবৈধ কারখানাগুলো সরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও গত ছয় বছরে নিমতলীর আশেপাশের এলাকা এবং পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা, দোকানগুলো সরিয়ে নেয়ার কোন কার্যত্রম গৃহীত হয়নি। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাস্পাকো অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডে ৩৯ জনের প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সত্তরের দশকে স্থাপিত হলেও পরবর্তীতে কারখানার ভবনগুলো অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়। কারখানায় জরুরী নির্গমনের কোনো পথ নেই এবং একটি ফটক দিয়েই শ্রমিকদের আশা-যাওয়া করতে হয়। ২০১৬ সালের ২২ আগষ্ট চট্রগ্রামের আনোয়ারার ডিএপি ফার্টিলাইজার লিমিটেডে ৫০০ টন অ্যামোনিয়া গ্যাস ধারণক্ষমতার ট্যাংক বিস্ফোরণে ৫০ জন আহতসহ প্রাণী ও উদ্ভিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারখানাটি ২০০৬ সালে স্থাপিত। অপরিকল্পিত কেমিক্যাল কারখানা, গোডাউন ও দোকানের যত্রতত্র বেড়ে উঠা এবং এসব দাহ্য পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ দাহ্য কেমিক্যালের সামান্যতম অব্যবস্থাপনায় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যা আমরা ইতোপূর্বে নিমতলী, চট্রগ্রামের সারকারখানা, টঙ্গীর টাম্পাকোসহ বিভিন্ন স্থানে বহু প্রাণের বিনিময়ে প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না।


বক্তারা বলেন, পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একই ভবনে রয়েছে শিল্পকারখানা, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন মালামালের গুদাম ও দোকান, বাণিজ্যিক কর্মকান্ড এবং আবাসিক ফ্ল্যাট। অলিতে-গলিতে গড়ে উঠছে রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা ও দোকান এবং প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানা। রাসায়নিক কারখানা, গুদাম, দোকানে আগুন নিভানোর নিজস্ব কোন ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনীয় রাস্তার অভাবে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ীগুলো দুর্ঘটনাস্থলে পৌছাতে পারে না। অনেক সময় অগ্নিকান্ডস্থলের কাছে জলাধার না থাকায় পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হয়। নিমতলী এলাকায় রাসায়নিকের পুরাতন গুদামের সংখ্যা কমে এলেও আবার নতুন গুদাম গড়ে উঠেছে, রয়েছে প্লাস্টিকের অনেক কারখানা। নিমতলী এখনো একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

 

পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়ার দাবীতে পবা দীর্ঘদিন যাবত আলোচনা সভা, গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের পর তা আরো গতি পায়।

ঢাকা মহানগরীতে এক হাজারেরও বেশী কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে ৮৫০টিরও বেশী অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের প্রয়োজন রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার কোন সুযোগ নেই।

 

আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, শিল্পকারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া না হলে নিমতলীর মতো আবারও যেকোন সময় বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। পুরান ঢাকায় বিদ্যমান বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, শিল্পকারখানা ও দোকানগুলো ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকার জনজীবন, জননিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই জরুরীভিত্তিতে পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।

 

শিল্পকারখানায় দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ- নিয়ম বহির্ভূত নির্মাণ, জরুরি নির্গমন পথ বন্ধ বা দখল করে রাখা, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র না থাকা, ড্রিল না করা, সরু ও অপর্যাপ্ত সিড়ি, নিয়ম বহির্ভূত কারখানার ফ্লোর ব্যবহার করা, দুর্বল স্থাপনা। বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাব, অগ্নি ও বিস্ফোরণের সাথে কেমিক্যাল নিরাপত্তা জড়িত। বাংলাদেশে কেমিক্যাল দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের সাথে সম্পর্কিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা হচ্ছে - রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাত শিল্প, টেক্সটাইল ও তৈরি পোষাক শিল্প, চামড়া শিল্প, কৃষিতে ব্যবহৃত কীটনাশক, গ্যাস সিলিন্ডার/তেলের ট্যাংক, রাসায়নিক সংরক্ষণাগার ও পরিবহন।

 

শিল্পকারখানায় উন্মুক্ত করিডোর থাকা প্রয়োজন। উন্মুক্ত করিডোর শুধুমাত্র কর্মদক্ষতার জন্যই ভাল নয়, তা যেকোন দুর্ঘটনায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্যও ভাল। প্রতিটি কারখানা ও স্থাপনায় ঝুঁকি নির্ণয় এবং সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করা, যেমন-আগুন জ্বলে ওঠার যেকোন উৎস নিরসন করা; কোনো দাহ্য পদার্থ কমানো বা সুশৃঙ্খলভাবে রাখা; পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা; বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা; যেকোন দাহ্য পদার্থ অগ্নি প্রতিরোধক স্থানে রাখা; ধূমপান নিষেধ নীতি সর্বদা চালু রাখা এবং সর্তকতা সংকেত স্থাপন করা; দুর্ঘটনাকালে সকল শ্রমিকের নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করা; অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নিয়মিত ফায়ার ড্রিল করা; দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ শীতল, বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা সম্পন্ন এলাকায় সংরক্ষণ করা এবং জ্বলে ওঠার সম্ভাব্য উৎস থেকে দূরে রাখা।

 

ফায়ার-এলার্ম ও যন্ত্রপাতি এবং জরুরি বেরিয়ে যাওয়ার পথ প্রাক-অগ্নি পরিকল্পনার অংশ হওয়া আবশ্যক। ফায়ার-এলার্ম বেজে উঠার সাথে সাথে কোন রকম আতঙ্ক না ছড়িয়ে জরুরি নির্গমন পথে বেরিয়ে যাওয়া এবং সকলের বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা। আগুন লাগলে তা নিভানোর জন্য যথাযথ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা। নিয়মিত ফায়ার ড্রিল পরিচালনা এবং তা ফলাফল লিপিবদ্ধ করা। যেমন- ড্রিলের তারিখ, বেরিয়ে যাওয়ার সময়, ড্রিলের ধরন, পর্যবেক্ষণ। এ ফলাফল জরুরি পরিকল্পনা উন্নয়নে সহায়ক ভূমিক্ াপালন করবে।

বিভিন্ন ধরনের অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণে ব্যবহৃত অগ্নি নির্বাপক পদার্থের ধরনও ভিন্ন। কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে সাধারণত জৈব পদার্থ-কাঠ, কাগজ এর জন্য পানি, ফোম বা বহুমুখী পাউডার অগ্নি নির্বাপক। তরল বা তরল জাতীয় পদার্থ- রং, তেল, চর্বি এর জন্য ফোম, কার্বনডাইঅক্সাইড, পাউডার অগ্নি নির্বাপক। বিদ্যুৎ যন্ত্রপাতির জন্য কার্বনডাইঅক্সাইড। কখনো পানি ব্যবহার করা যাবে না। গ্যাসীয় পদার্থ- পাউডার অগ্নি নির্বাপক।

 

টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকাসহ সারা দেশের বিসিক শিল্প এলাকায় বিসিকের অফিস রয়েছে এবং প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বিসিকের অনুমোদিত লে-আউট অনুযায়ী নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করার বিধান রয়েছে। টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায় বিসিকের অফিস থাকা সত্ত্বেও টাস্পাকো অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানা কিভাবে অবৈধ নির্মাণ করে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একই সাথে কর্মস্থলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখার দায়িত্ব শ্রম অধিদপ্তরের । কিন্তু কারখানাটিতে জরুরি নির্গমন পথ নেই, এবং একটি মাত্র ফটক দিয়ে শ্রমিকদের আশা-যাওয়া করার বিষয়টি শ্রম অধিদপ্তরের নজর কিভাবে এড়িয়ে গেল তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

 

শুধুমাত্র কেমিক্যাল সংশ্লিষ্ট কারখানার ৩ জুন ২০১০ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত সংঘঠিত অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণ দেখানো হয়েছে যে, নিহতের সংখ্যা ১৪৫৩ এবং আহত হয়েছে অনেক। এসময়ে তাজরিন ও রানা প্লাজা ছাড়া ৩৩টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১১টি বয়লার বিস্ফোরণ যা ৩৩%, অগ্নিকান্ড ৮টি যা ২৪%, ৫টি গ্যাস নিৎসরণ যা ১৫%। তাজরিন ও রানা প্লাজা ছাড়া ২০৬ জন নিহত ও ৩৯৩ জন আহত এবং ১১ জন নিখোজ। প্রাণী ও উদ্ভিদ, ভৌত অবকাঠামো এবং কাচামাল ও উৎপন্ন দ্রব্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

করণীয়ঃ
১. আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম, কারখানা ও দোকান অপসারন এবং সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে কেমিক্যাল ও বয়লার ব্যবহার নিরাপদ করতে সরকারের সংশিষ্ট দফতর সমূহের কার্যকর পদক্ষেপের সময় নির্দিষ্ট মহাপরিকল্পনা বা রোড ম্যাপ দরকার।
২. ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেয়া।
৩. বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকানের জন্য সরকার কর্তৃক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ব্যবস্থাসহ একটি পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলা।
৪. কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অদিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, বয়লার পরিদর্শক, শ্রম অধিদপ্তর, বিসিক, বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন কর্তৃক সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৫. পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক আবাসিক এলাকায় পরিচালিত কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম- এর বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।।
৬. বিভিন্ন শিল্প এলাকায় বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানাগুলো পাশাপাশি স্থাপন করা।
৭. পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর সব এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা, গুদাম সরাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা।