শিশুর শিক্ষা হোক মাতৃভাষা ও আনন্দঘন পরিবেশে
শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ, সুস্থ ও প্রকৃতিসম্মত পরিবেশ। শিশুর বিকাশের প্রধান স্থান তার পরিবার। মাতা-পিতা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের অসদাচরণ, মিথ্যাচার, দূনীতিপরায়নতা, ভারসাম্যহীন ব্যবহার শিশুকে বিপথগামিতা করে। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন দ্বারা শিশুরা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে শিশুকিশোরদের অনন্য এক ভুবন। এখানে লেখাপড়ার সাথে সাথে তাদের সামাজিকীকরণ  হয়। এখানে বন্ধু, সহপাঠি, শিক্ষক দ্বারা ব্যক্তি শিশু খুব বেশি প্রভাবিত হয়। শিশুদের বইয়ের বোঝা বহন করতে করতে পিঠ বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট পড়া, পাঠের বোঝা তার জ্ঞানচর্চা ও পড়ার আনন্দ নষ্ট করে দিচ্ছে। খেলার মাঠ নেই, নেই পার্ক, লেক, বিনোদনের জায়গা। শ্বাস নিতে হচ্ছে দূষিত বাতাসে। শহরগুলোতে ইটের বস্তি, গৃহস্থালী, হাসপাতাল,ক্লিনিক, শিল্প বর্জ্যরে স্তুপ। শিশুরা বেড়ে উঠছে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, যার ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আজ ২১ অক্টোবর ২০১৬, শুক্রবার, সকাল ০৯.০০ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-মিলনায়তনে ফ্রয়বেল চাইল্ড এডুকেশন স্কুল সোসাইটি ও পবা’র যৌথ আয়োজনে “শিশু শিক্ষার পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষা” শীর্ষক সেমিনার এবং ফ্রয়বেল পদক, বৃত্তি, সনদ প্রদান অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। সেমিনারে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উক্ত অভিমত প্রকাশ করেন। 
 
বিশিষ্ট কবি ও মাননীয় সংসদ সদস্য কাজী রোজি এর সভাপতিত্বে সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার সাধারন সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান এবং প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য- প্রফেসর এ এম এম সফিউল্লাহ, বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার উদ্বোধক রফিকুল ইসলাম দাদু ভাই, দৈনিক সমকালের উপ-সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, কবি আসলাম সানি, কবি সুজন হাজং ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফারুক হোসেন প্রমুখ।
 
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করেছে। শিক্ষানীতিতে বাংলাদেশের সংবিধানের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কতিপয় বিধানের পাশাপাশি জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রত্যেক সদস্য দেশে সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে। শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। 
বক্তরা আরও বলেন, শিক্ষার মাধ্যমেই জাতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে। মাতৃভাষায় প্রকৃতি নির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।  জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যাধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানস¤পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একাজ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। শিক্ষার এইস্তর পরবর্তী সকলস্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্পন্ন উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষার পর অনেকে কর্মজীবন আরম্ভ করে বলে মানস¤পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা তাদের যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে স্থান ও বিদ্যালয় ভেদে সুযোগ-সুবিধার প্রকট বৈষম্য, অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক-স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণের দুর্বলতাসহ বিরাজমান সমস্যাসমূহ দূর করে জাতির সার্বিক শিক্ষার ভিত শক্ত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সকলের জন্য একই মানের। অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক এবং ভৌগোলিক কারণে বর্তমানে শতভাগ শিশুদের প্রাথমিক স্কুলের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি ৫ বছর, যা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বুাদ্ধও বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হবে- বাংলাদেশের শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, ক্সনতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন করা এবং তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা।
প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে-
 
১. শিশুর মনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সাম্য, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাবোধ জাগানো এবং তাকে শান্তিময় পরিবেশের প্রতি আগ্রহী করে তোলা।
২. পারিবারিক, সামাজিক ও বিদ্যালয়ের কর্মকা-ে সμিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুকে তার নিজের ও অপরের অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
৩. জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি লাভে সহায়তা করা এবং এগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা।
৪. শরীরচর্চা ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক বিকাশে সহায়তা করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করা।
৫. জীবনের সবর্ স্তÍরে কার্যকর ব্যবহারের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার সকল মৌলিক দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা। 
৬. শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, প্রবণতা ও আগ্রহ অনুসারে তাকে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা এবং পরবর্তী স্তরে শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
 
 
সুপারিশঃ
 
১. বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী বয়সী সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। 
২. সকল শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
৩. প্রাথমিক শিক্ষার পরিমানগত উন্নয়নের পাশাপাশি গুনগত মান অর্জনে গুরুত্ব আরোপ করা।
৪. সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তাচেতনা গড়ে তোলা এবং জাতির জন্য সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ধারার শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাμম, পাঠ্যসূিচ ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করা।
৫. দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি শ্রেণীতে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকের অনুপাত কমিয়ে আনতে শিক্ষকের অতিরিক্ত পদ সৃষ্টিসহ শুণ্যপদে যথাসময়ে নিয়োগ প্রদান। 
৬. প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকসহ কর্মকর্তাদের মাঝে উদ্দীপনা সৃষ্টিতে যথাসময়ে পদোন্নতি প্রদানসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যμম গ্রহণ করা।
৭. ছাত্র-ছাত্রীদের গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা প্রদান কার্যμম ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। 
৮. প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর সুরক্ষা ও যথাযথ বিকাশের অনুকূল আনন্দময় ও সৃজনশীল পরিবেশ গড়ে তোলা। 
৯. শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।
১০. শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা।
১১ পথশিশুসহ আর্থ-সামাজিকভাবে বঞ্চিত সকল ছেলে-মেয়েকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর (যেমন: ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক-চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎজীবন যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো লক্ষ্যে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।