বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক রক্ষার জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ
বাংলাদেশের রয়েছে কয়েক হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ, অনুসন্ধান ও উৎখননের মাধ্যমে অদ্যবধি এ ঐতিহ্যের কিছুটা উদ্ধার করা সম্ভব হলেও অজানা রয়ে গেছে অনেক কিছুই। অন্যদিকে ভূমির উপরিভাগে বিদ্যমান নিদর্শন কিংবা খননে উন্মোচিত ঐতিহ্যগুলোও প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা  কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই প্রতœতাত্ত্বিক ও জরিপ ও উৎখননের পাশাপাশি সময়ের আবর্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এর নিয়মতান্ত্রিক সংরক্ষণের বিষয়টি।
 
বাংলাদেশের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের নানা সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আজ ০৩ নভেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, সকাল ১০.০০ টায় প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর যৌথ আয়োজনে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে ‘প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক দিনব্যাপী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
 
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন-এর সভাপতিত্বে সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আই এ বি-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সামশুল ওয়ারেস। অন্যান্য অতিথির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন      পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, আই এ বি-এর সভাপতি স্থপতি আবু সাইদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নেসার আহমেদ, পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী, সহ সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম শামীম, অধ্যাপক আয়েশা বেগম,  অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান, ড. মো. আতউর রহমান সহ আরো অনেক শিক্ষক-গবেষক এবং ঐতিহ্য অনুরাগী। 
 
সেমিনারের সূচনা বক্তব্য রাখেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর চেয়াম্যান আবু নাসের খান। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস-ঐতিহ্য বাঁচাতে জনগণকে সাথে নিয়ে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নেসার আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো বাদে ঐতিহ্য সংরক্ষণের মত জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ কাজ সূচারুরূপে করা সম্ভব নয়। প্রধান অতিথি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আকতারী মমতাজ তার লিখিত বক্তব্যে আশ্বস্ত করেছেন যে, এই সেমিনারে গৃহীত সুপারিশ সমূহ সরকারের নীতি প্রণয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক সামশুল ওয়ারেস বলেন, প্রতœসম্পদ উৎখনন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে বৈজ্ঞানিকভাবে।
 
 মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে অধ্যাপক শাহনাওয়াজ উল্লেখ করেন  ‘বাংলাদেশের অনেক প্রতœনিদর্শন ভূমিদস্যুদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কখনও কোনো স্থাপনা যেমন মন্দির, বসতবাড়ী ইত্যাদি যখন ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় থাকে এ সময় আশেপাশের ভূমিদস্যুরা স্থাপনা থাকার কারণে তা সহজে গ্রাস করতে পারে না। তখন তারা নানাভাবে চেষ্টা করে এগুলোকে সরিয়ে দিয়ে জমির উপর নিজেদের দখল নিশ্চিত করতে। সরকারী নানা দফতর নিজেদের অধিকারে রেখে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দুর্গ। সম্প্রতি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে দখলমুক্ত করে সংস্কার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুলতানি যুগে ঢাকার একমাত্র মসজিদ নিদর্শন বিনত বিবির মসজিদ নামে পরিচিত নারিন্দার ‘বখত বিনতের মসজিদ’ ভেঙে বহুতল মসজিদ স্থাপনা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে। অবশেষে গুরুত্ব বোঝানোর পরে মূল মসজিদ কক্ষটি রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু চুড়িহাট্টা মসজিদটি আমরা আর রক্ষা করতে পারিনি। কখনও কখনও আমাদের অসচেতনতা, অদক্ষতা ও ইতিহাসবোধ সংকটের কারণে বড় রকমের বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। জনপ্রতিনিধিরাও ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক প্রতœ-নিদর্শনের ভয়াবহ ক্ষতি করেছেন। যেমন, ঐ বাগেরহাটেরই খানজাহান আলীর সমাধি সংলগ্ন ঠাকুর দিঘিতে সুলতানি আমলে নির্মিত ইটের ঘাটটি আধুনিক টাইলসে মুড়িয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় সাংসদ। স্থানীয় মানুষের অসচেতনতা এবং সংশ্লিষ্ট রক্ষকদের যথাযথ দৃষ্টি না দেয়ার কারণে প্রতœস্থাপনাগুলো সংকট ক্রমে বড় হচ্ছে। যেমন জলদুর্গগুলোর ভেতরের চত্বর স্থানীয় তরুণদের ক্রিকেট-ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের নানা স্থানে অনেকটাই নিয়মিতভাবে এমন ঘটনা ঘটছে যার থেকে উত্তোরণে জনগণের সম্পৃক্তি ও সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই ’।
 
সেমিনার শেষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারে সুপারিশ করা হয়।
 
সুপারিশ সমূহ:
 
   ১. প্রতœসম্পদ সংরক্ষণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
   ২. প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখা ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দেয়া।
   ৩. প্রতœসম্পদ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজের সমন্বয় সাধন করা।
   ৪. প্রতœঐতিহ্যের সাথে জনসম্পৃক্তি বৃদ্ধি করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
   ৫. দেশে প্রতœসম্পদ সংরক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
   ৬. প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরকে বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা।
   ৭. ব্যবস্থাপনা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলোকে যুগপযোগী করে তোলা।
   ৮. দেশের প্রতিটি প্রতœনিদর্শনকে যতদূর সম্ভব চিহ্নিতকরণ ও নথিভুক্তকরণে উদ্যোগ নেয়া।
   ৯. সরকারী কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ সংরক্ষনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। 
  ১০. প্রতœতাত্ত্বিক পর্যটনের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।