নদী রক্ষায় দখলমুক্ত করার খেলা বন্ধ কর
নদী রক্ষায় দখলমুক্ত করার খেলা বন্ধ কর
 
ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বেপরোয়া দখলের মাধ্যমে নদীসমূহ ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। নদী রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে অথচ অভিযানে উদ্ধারকৃত জায়গাও নদীকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে না, কিছুদিন পর উদ্ধারকৃত জায়গা পুণরায় দখলের কবলে পড়ছে। অধিকাংশ সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে নদীর ভিতরে এবং অনেক জায়গায় পিলারের ভিতরে ভরাট করে নদী দখল চলছে। সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে এব্ং মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অবমাননা করে নদী রক্ষায় কেবল উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা চলছে আর নদী দখল চলছে নির্বিচারে। ঢাকার অস্তিত্বের প্রয়োজনে এর চারিপার্শ্বস্থ নদীসমূহ রক্ষায় দখলমুক্ত করার এ খেলা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র উদ্যোগে ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী, ‘দখলমুক্ত রাখার উদ্যোগ ও বাস্তবতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত দাবী জানান।
 
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেনের সঞ্চালনায়
বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, ডা: লেলিন চৌধুরী, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্রাচার্য, বিশিষ্ঠ কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, পবার সদস্য সাইফুল ইসলাম শোভন, ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যাপক ড. মসিউর রহমান, বিআইডব্লিউটিএর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, নোঙর এর সভাপতি সুমন শামস প্রমুখ। 
 
বক্তারা বলেন, আমাদের দেশের রাজধানী  শহর এবং সংলগ্ন এলাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিশ্বের কোন দেশের রাজধানী  অথবা মেট্টোপলিটন শহরের প্রতি প্রকৃতির এই আর্শীবাদের দৃষ্টান্ত বিরল। জীববৈচিত্রের আধার, কৃষি, পরিবহন, পানীয় জলসহ নদী নির্ভর জীবন-জীবিকার উৎস হিসেবে এই নদীসমূহের ব্যবহার বহুদিন আগের ঘটনা নয়। দু:খজনল হলো একদিকে দখল এবং অন্যদিকে দূষণের ক্রমবর্ধমান ও অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে নদী সংকীর্ণ হয়ে ব্যবহার উপযোগীতা হারাচ্ছে। দখলের মাধ্যমে সরু হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুম ছাড়া অনেক জায়গায় নৌ পরিবহন সম্ভবপর হয়ে উঠে না। শুকনো মৌসুমে দুর্গন্ধে নদী পাড়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে। অথচ ঢাকাকে পরিবেষ্টিত এই নদীসমূহের নাব্যতা ঠিক রেখে দূষণ যদি রোধ করা যেত তবে সুপেয় পানির সরবরাহে যেমন ভ’গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানো যেত, তেমনিভাবে নগরীর অভ্যন্তরীণ যাতায়াত দুর্ভোগ লাঘবে নদী পথ অন্যতম মাধ্যম হতে পারতো। তাছাড়া নদী নির্ভর বিশাল অর্থনীতি সম্প্রসারণের অমিত সম্ভাবনাও রয়েছে নদীগুলোকে ঘিরে।  
 
অথচ বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি নির্বিচার দখল, অস্থায়ী ডক ইয়ার্ড নির্মাণ, ইটভাটা তৈরির মাধ্যমে দখল ছাড়াও পাঁকা, আধাপাঁকা ও কাচা ঘর নির্মাণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নদীসমূহ দখলে চলে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়নগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এলাকার পয়ঃবর্জ্য এবং গৃহস্থালী বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য, হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য, নৌযান নির্মাণ, মেরামত ও রংকরণ, নৌযান থেকে নির্গত তেল এবং নৌযানের  বর্জ্যে নদী দূষণ ও দখল চলছেই। 
 
নদী দখলের ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে কেরাণীগঞ্জের কামরাঙ্গীর চর এলাকায়। ড্রেজার দিয়ে বালু ফেলে নদী ভরাট করে আবাসন কোম্পানির প্লট বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তুতি চলছে দ্রুত গতিতে। তারই পাশের বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল দখল ও ভরাটের এক জলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে। ক্রমবর্ধমান ও অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে এটি এখন মৃত। দখল চলছে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে। বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি নিচু জমি, খাল, বিল, নদী দখলের প্রতিযোগীতায় নেমেছে। 
 
মহামান্য হাইকোর্ট ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী রক্ষায় সময়ে সময়ে যুগান্তকারী আদেশ দিয়েছেন। নদীর সীমানা সিএস রেকর্ড অনুযায়ী নির্ধারণ, তীরবর্তী অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ, নদীর সাথে সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালীর লাইন ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণ লাইন বন্ধ করা, নদী দূষণমুক্ত রাখা ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং নদীতে বর্জ্য ফেলা রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, নদীতীরের বর্জ্য অপসারণ এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এ  নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
নদী দখলের এই জঘন্য প্রতিযোগিতা বন্ধে আমাদের প্রস্তাবনা ঃ 
১. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জিপিএস এর ভিত্তিতে নদীর সীমানা চিহ্নিত করে নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
২. আবাসন নির্মাণের জন্য কামরাঙ্গীর চরের চলমান নদী ভরাট অনতিবিলম্বে বন্ধ করা এবং দখলদারদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা;
৩. বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সকল অবৈধ দখল অপসারণ করে এর প্রবাহ ফিরিয়ে আনা;
৪. ঢাকার চারপাশের নদীসমূহের অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ করা;
৫. গৃহস্থালী বর্জ্য পানি প্রবাহে ফেলা থেকে বিরত থাকা;
৬. শিল্পকারখানায় বর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন এবং নিয়মিত তা পরিচালনা মনিটরিং করা; 
৭. নৌযানের ডিজাইনে বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা; 
৮. বিআইডব্লিউ কর্তৃক নৌযানের বর্জ্য সংগ্রহকরণ ও তা পরিশোনপূর্বক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ; 
৯. ট্যানারীগুলো জরুরীভিত্তিতে সাভারের ট্যানারী শিল্পনগরী স্থানান্তর করা;
১০. গৃহস্থালী বর্জ্য নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকা;
১১. উচ্ছেদকৃত স্থান আবার যাতে ভূমিদস্যুদের দখলে চলে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।