মকিম বাজার, হাজারীবাগ ট্যানারী ও নিমতলীতে ভয়াবহ মর্মান্তিক রাসায়নিক বিষ্ফোরনের স্থান পরিদর্শন প্রতিবেদন।
মকিম বাজার, হাজারীবাগ ট্যানারী ও নিমতলীতে ভয়াবহ মর্মান্তিক রাসায়নিক বিষ্ফোরনের স্থান পরিদর্শন প্রতিবেদন।
 
সম্প্রতি বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানসমূহে বিপদজনক রাসায়নিক দ্রব্যাদির দায়িত্বহীন ব্যবহার  ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে মর্মান্তিক দূর্ঘটনা। নিহত বা আহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। উক্ত বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি ও সেন্টার ফর এক্সিলেন্স এর উদ্দোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকাররম ভবনের সেন্টার ফর এক্সিলেন্স সম্মেলন কক্ষে ‘‘মকিমবাজার, হাজারীবাগ ট্যানারী ও নিমতলীর ভয়াবহ রাসায়নিক বিস্ফোরণ সরেজমিনে পরিদর্শন প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপন ও করণীয়’’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এক্সিলেন্স এর পরিচালক  ও বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির সভাপতি, অধ্যাপক এম. মুহিবুর রহমান। 
 
আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী, উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক এ এম এম সফিউল¬াহ, উপাচার্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম, ডীন, বিজ্ঞান অনুষদ, ঢা. বি.; আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাচাও আন্দোলন; প্রফেসর ড. জসীম উদ্দিন আহমদ, রসায়ন বিভাগ, সাবেক উপাচার্য, জা.বি.; প্রফে. ড. শাহনাজ হক হুসেন, ডীন, আর্থ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ঢা.বি.সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ।
 
 
গত বৃহষ্পতিবার রাত্রে নিমতলী এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ১১৭ জনের প্রাণহানি ঘটল। আরো অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। ঘটনা সমগ্র জাতিকে মর্মাহত করেছে, এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বিগত শনিবার ৫ই জুন রাষ্ট্রীয় শোকদিবস পালিত হয়েছে। 
 
 
বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-এর পক্ষ থেকে আমরা শনিবার এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। এলাকাটি তখনও কোন ধরনের যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। এলাকাটি ছিল লোকারন্য। যে স্থানটিতে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়, সেখানে তখনও একটি পোড়া মটর সাইকেল পড়ে রয়েছিল। যে ঘরটিতে অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতার জন্য দায়ী রাসায়নিক দ্রব্য ছিল সেটি অন্ধকার ছিল। উপরে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার দেখে অপাততঃ দৃষ্টিতে অক্ষত মনে হল। পার্শ্বের ছয়তলা বিল্ডিং এর দেয়ালে আগুনের ক্ষতচিহ্ন লক্ষ করা গেল। এই ভবনের প্রায় সকলেই নিহত হয়েছিলেন। 
 
প্রকাশিত খবর বিশে¬¬ষন এবং স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে আলাপের পর মনে হচ্ছে, একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য রান্নার চুল¬ী থেকে কোনও ভাবে পাশের ঘরের রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে প্রথমে আগুন লাগে; এই ঘরে ড্রামটিতে মিথাইল ক্লোরাইড এবং টলুইন ডাইআইসোসায়ানেট ছিল। প্রথমটি একটি গ্যাস, যার ফ্ল্যাশ পয়েন্ট -৪৬০ঈ। এটি একটি অতি সহজেই দাহ্য পদার্থ। অনুমান  করা যায় যে ড্রাম থেকে লিক করে বেরিয়ে যাওয়া মিথাইল ক্লোরাইড প্রথমে অগ্নির সংস্পর্শে আসে, এবং ড্রামটিতে বিস্ফোরন ঘটে। ছোট ঘরে এর ফলে যে উচ্চতাপ মাত্রার সৃষ্টি হয, তাতে পার্শ্বের টলুইন আইনেসাসার্য়ানেট (ফ্ল্যাশ পয়েন্ট ১৩২০ঈ) ভর্তি ড্রাম উত্তপ্ত হয় এবং ড্রামটি ফেটে যায়। উচ্চতাপে এই দ্রব্যটির দহণ ঘটে, এবং ফলে প্রচন্ড তাপসৃষ্টির সাথে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হতে থাকে। ঘরটিতে কয়টি ড্রাম ছিল, তার খবর এখনও পাওয়া যায় নাই। তবে অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা থেকে অনুমেয় যে সেখানে বেশ কয়েকটি ড্রাম ছিল। মনে হচ্ছে নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই বিষাক্ত গ্যাসের কারনেই মৃত্যুবরন করেছেন এবং পরে তাদের দেহ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। আশে পাশে আরো কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে ও আগুন ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিস্ফোরণ ঘটে। পুরা এলাকা জুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 
 
ঘটনাটি মর্মান্তিক। সামাজিক অনুষ্ঠানের অতিথিরাও এর শিকার হয়েছেন, হয়েছেন শিশুরাও, হয়েছেন বিয়ের কনে। ঢাকা শহরের বেঁচে থাকার জন্য জীবনের ঝুকি নিয়ে যে ভাবে আমরা বিভিন্ন কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছি তাতে নিমতলীর ঘটনার মত ঘটনা যে অহরহ ঘটে না, তা আল¬াহর অশেষ মেহের বানী। বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির দুই দিন ব্যাপী ঈযবসরপধষ ঐধুধৎফং ্ ঝধভবঃু শীর্ষক ওয়ার্কশপের ফিল্ড-ভিজিটে আমরা মিটফোর্ড এলাকা পরিদর্শন করেছিলাম। আমাদের সংগে ছিলেন পবার চেয়ারম্যান জনাব আবু নাসের খান। সেখানে রাস্তার পার্শ্বের দোকানে বিভিন্ন দ্রাবক ভর্তি ড্রাম সাজানো ছিল; কোন কোন ক্ষেত্রে ঘরের সংকীর্ণতার কারনে রাস—ার মধ্যে ও ড্রাম রাখা হয়েছিল। গত ১৬ই ফেব্র“য়ারী আরমানিটোলার মকিম বাজার এলাকায় এক বিস্ফোরন ঘটে। পরদিন জনাব নাসের খান ও আমি অকুস্থলটি পরিদর্শন করি। যে ঘরে বিস্ফোরন ঘটে, সেটি তখন তালা দেয়া ছিল, মালিক তখন কোর্টে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রাপ্ত তথ্য বিশে¬ষন করে মনে হল এমোনিয়া ভর্তি একটি সিলিন্ডার-এর রেগুলেটর ভেঙ্গে গিয়ে এই বিস্ফোরন ঘটেছিল। অগ্নিকান্ড না ঘটায় ঘটনাটি মর্মান্তিক রূপ নেয় নি,-পাশের ঘরেই ঠাসাঠাসি করে রাখা ছিল প্রায় পনেরটি দ্রাহ্য দ্রব্য ভর্তি ড্রাম। যে কর্মচারীটি আমাদেরকে এগুলো দেখালেন, তিনি এই দ্রব্যকে নিরাপদ তৈল হিসাবেই দেখেন, এতে অগ্নিসংযোগ হলে কি মারাত্মক পরিস্থিতি হতে পারে সেই ব্যাপারে শুধু তিনি নন, বাড়ীর মালিক স্বামী-সন্তানাদি নিয়ে উপরতলায় বসবাসরত প্রৌঢ় মহিলাকেও সম্পূর্ণ অজ্ঞ মনে হল। 
 
বিগত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে হাজারীবাগ এলাকায় চামড়ার ট্যানারি ফ্যাক্টরীতে যে রাসায়নিক বিস্ফোরন ঘটে, তাতেও একাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারান। ঘটনার দুইদিন পরে পবার পক্ষ থেকে অকুস্থল পরিদর্শন করা হয়। বিষাক্ত গ্যাসের দুর্গন্ধ তখন ও প্রকট ছিল। প্রাপ্ত তথ্য বিশে¬ষন করে বোঝা গেল যে শ্রমিকরা ভুল করে সোডিয়াম সালফাইডের মধ্যে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ঢেলে দিয়েছিল, যার ফলে বিপুল পরিমান বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস-ই প্রাণহানির কারণ। ফ্যাক্টটরীর ব্যবস্থাপনাকেই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে আমরা মনে করি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন প্রাপ্ত রসায়ন বিষয়ে ন্যুনতম জ্ঞান-সম্পন্ন একজন কর্মীর তত্বাবধান এই ধরনের কর্মকান্ডের জন্য অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি, এবং বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি ও পবা-এর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আমরা এই দাবী জানাই। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ঝুকি নিয়ে ঢাকা শহরে, বিশেষ করে পুরান শহর এলাকায় আমরা অসংখ্য রাসায়নিক ফ্যাক্টরীর ও রাসায়নিক গুদামের অপারেশন মেনে নিচ্ছি, সেটি কি অপরিহার্য্য; আমরা কি নিমতলীর ঘটনার মত ঘটনাকে মেতে নেবো? আমরা মনে করি এই অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। 
সুতরাং আমরা দাবী জানাচ্ছি যে
* অবিলম্বে রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন, গুদামজাতকরণ ও যধহফষরহম-এর জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ণ ও তার বাস্তবায়ন করা হোক। 
* কেবল মাত্র একজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রসায়নবিষয়ে ন্যুনতম জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির তত্বাবধান রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন, গুদামজাতকরণ ও যধহফষরহম-এর জন্য বাধ্যতামূলক করা হোক। 
* রাসায়নিক বর্জ নিষ্কাশনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক। 
* লোকলয়ে রাসায়নিক দ্রব্যাদির গুদামজাত করণ, বিপনন ও উৎপাদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হোক। 
* প্রচলিত এবং নুতন বিধিমালার যথাযত প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক। 
* শহরতলীতে একটি পৃথক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করে সব ধরনের রাসানিক দ্রব্যের ফ্যাক্টরী ও গুদাম শহর থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হোক। 
* বিল্ডিং কোড ২০০৬-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হোক। (পবা-ও সুপারিশমালা)
*পূরান ঢাকার জন্য বাস্তবমূখী দীর্ঘ মেয়াদী নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক, যাতে ধাপে ধাপে পূরানো ঘরবাড়ী ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণ করে প্রকৃত মালিকদের জন্য আধুনিক সুবিধাসহ নিরাপদ নগর গড়ে উঠতে পারে। 
* স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসাবে অনতিবিলম্বে প্রত্যেকটি রাসয়নিক কারখানায় এবং গুদামে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা          বাস্তবায়ন করা হোক। 
* রাসায়নিক কারখানায় কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। 
* বহুতল বিশিষ্ট ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য রাজউক-এর ক্ষমতা সংসদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হোক। 
* রাজউক যে উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য একটি ভবনের নক্সা অনুমোদন করে, ভবনটি সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটি মনিটারিং করা ও বিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।