ভয়াবহ ধূলা দূষণের কবলে ঢাকা মহানগরী
নানা ধরণের দূষণে ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ আজ সংকটাপন্ন। এক এক পরিবেশ দূষণ এক এক রকম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। ধূলা দূষন আরও একটি অন্যতম পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাথ্যের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। ধূলাদূষণ যথাযতবাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে সুনিদ্রিষ্ট নীতিমালা ও তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি ধূলা দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা তৈরীর জন্য সরকার, বেসরকারী সংগঠন ও সচেতন মহলকে যথাযত দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে মূল উদ্যোগটি সরকারকেই নিতে হবে। তানাহলে ঢাকা মহানগরী এক সময় ধূলার নগরে পরিণত হবে। আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সকাল ১১ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ধূলা দূষণ পর্ষদ এর উদ্যোগে “মহানগরীতে ধূলা দূষণের ভয়াবহতা : কারণ ও করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকগণ এ অভিমত ব্যক্ত করে। 
 
উপস্থিত ছিলেন- তেল-গ্যাস, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, প্রকৌশলী অধ্যাপক ড. শামসুল ওয়ারেস, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রোকেয়া পদক প্রাপ্ত লতিফা আকন্দ, সিটি কর্পোরেশনের চিফ টাউন প্ল্যানার মোঃ সিরাজুল ইসলাম, ডা. মো: জিয়াউল করিম, বিডিডিএল গ্র“পের চেয়ারম্যান ও রিহ্যাবের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল বিদ্যূৎ, মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন-ধূলা দূষণ পর্ষদ এর প্রতিনিধি মোহাম্মদ জাফর বেগ, ধূলা দূষণ পর্ষদ এর প্রতিনিধি সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ শুভ এবং সঞ্চালনার ভূমিকায় ছিলেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। 
 
বায়ূতে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, সীসা, তামা, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ধূৃলিকণা ইত্যাদি থাকে। প্রত্যেকটি উপাদানের একটি সহনীয় মাত্রা রয়েছে। কোন উপাদান এই মাত্রার বেশি বা কোন কোন ক্ষেত্রে কম থাকলে আমরা তাকে বলি বায়ূ দূষণ। বাযূতে ভাসমান ধূৃলিকণার সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ২০০ মাইক্রোগ্রাম। ধূলার পরিমান এর বেশি হলে যে বায়ূ দূষণের সৃষ্টি হয় তাকেই বলে ধূলা দূষণ। ধূলিকণার আকার ১০  মাইক্রেনের বেশি হলে বায়ুতে ভেসে থাকতে পারে না; নিচে পড়ে থিতিয়ে যায় । ছোট আকারের ধুলিকণাই বায়ুতে ভেসে থেকে ধূলা দূষণ ঘটায়।
 
ধূলা দূষণ যেভাবে হয়ঃ
(১)স্বাভাবিক কারণে প্রতিদিন রাস্তায় কিছু ধূলা জমে যা প্রতিদিন অপসারণ করতে হয়। এই ধূলা ঠিকমত অপসারণ না করার ফলে ধূলা জমতে থাকে। জমে যাওয়া এই ধূলা চলন্ত যানবাহনের গতিতে বাতাসে মিশছে এবং ধূলা দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। (২) গ্যাস, পানি, টেলিফোন, স্যুয়ারেজ ইত্যাদি পরিসেবার ভূগর্ভস্ত সংযোগ প্রায় সকল ক্ষেত্রে রাস্তার নীচ দিয়ে গিয়েছে। এই সব পরিসেবার সংযোগ মেরামত, বৃদ্ধি ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খনন করা হয়। খননে সৃষ্ট মাটি রাস্তার উপরেই স্তুপ করে রাখা হয়। নানাভাবে এই মাটি পুরো রাস্তা ও এর আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। (৩) দালান-কোঠা বা অন্য কোন অবকাঠামো তৈরীর সময় নির্মান সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় রাখা হচ্ছে যা থেকে ধূলাদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি নির্মান কাজের সময়ও যথাযথ প্রতিরোধক ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে ধূলা দূষণ তৈরী হচ্ছে। দালান-কোঠা বা অবকাঠামো ভাঙ্গার সময়ও যথাযথ পদ্ধতি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা না নেয়ায় ধূলা দূষণ তৈরী হচ্ছে। আমাদের দেশে সাধারণত দালান-কোঠা বা অবকাঠামো ভাঙ্গার সময় হাতুড়ি বা এই জাতীয় বস্তু ব্যবহার করা হয় যার ফলে ভাঙ্গার সময় ধূলা উৎপন্ন হয়। (৪) বিভিন্ন সামগ্রী ট্রাক বা অন্য কোন বাহনে পরিবহনের সময় ঠিকমত আচ্ছাদন দেয়া হচ্ছে না ফলে তা থেকে বাতাসে ধূলা ছড়াচ্ছে। অনকে সময় এসব বাহনে মাটি, বালি, ইট এধরণের জিনিস বহন করা হয় ঠিকমত আচ্ছাদন ও প্রতিরোধক না থাকার ফলে এ থেকে মাটি ও ধূলা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকে সরাসরি বাতাসে ধূলাও ছড়ায়। (৫) রাস্তার পাশের ড্রেন পরিস্কার করার সময় ড্রেন থেকে তোলা আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা হচ্ছে। যা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং শুকিয়ে ধূলায় পরিণত হচ্ছে এবং ধূলা দূষণ সৃষ্টি করছে। (৬)গৃহস্থালী আবর্জনা যথাযথ স্থানে না ফেলে রাস্তায়, খোলা জায়গায় বা এখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। আবার পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ডাস্টবিনের ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহের সময় যথাযথভাবে সংগ্রহ করছেনা। কিছু ময়লা প্রতিদিন থেকে যাচ্ছে। এবং আবর্জনা পরিবহনের সময় অসাবধানতা ও অবহেলার কারণে আবর্জনা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে যা থেকেও ধূলাদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। (৭) কোন এলাকায় ভাঙাচোরা রাস্তা দীর্ঘদিন মেরামত করা হচ্ছেনা। এসব ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রচুর ধূলা উৎপন্ন হচ্ছে। বাতাস বা যানবাহনের গতিতে এসব ধূলা সব সময় বাতাসকে দূষিত করে রাখছে। আবার রাস্তা মেরামতেও দীর্ঘ সময় নেয়া হচ্ছে যা থেকেও ধূলা উৎপন্ন হচ্ছে এবং অনুরুপ ভাবে ধূলাদূষণ তৈরী করছে। (৮) রাস্তার পাশে অবস্থিত দোকান সমূহ পরিস্কার করার পর এতে সৃষ্ট ধূলা ও আবর্জনা রাস্তায় ফেলা হচ্ছে। এবং রাস্তার উপর ও আবাসিক এলাকায় ইট ভাঙ্গার মেশিনে ইট ভাঙ্গার সময় ধূলা উৎপন্ন হচ্ছে এবং ধূলা দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। (৯) ঢাকার ফুটপাতের গঠন প্রকৃতি এমন যে তাতে সহজেই ধূলা জমে থাকতে পারে। একে ধূলামুক্ত রাখতে নিয়মিত ধূলা অপসারণ করা দরকার। কিন্তু তা না করার ফলে এখানে ধূলা জমে থাকছে। এই ধূলা ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তা আশেপাশের দোকান প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া ভাঙ্গা ফুটপাতও ধূলাদূষণের কারণ। (১০) নগরের বাইরে থেকে যে সব যানবাহন নগরে প্রবেশ করছে তার চাকা ও শরীরে যথেষ্ট পরিমান ধূলা লেগে থাকে। এই ধূলা নগরীর রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং ধূলা দুষণের সৃষ্টি করছে।
 
এই ধূলা দূষণ আমাদের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ধূলা দূষণ যেমন স্বাস্থ্য হানি ঘনাচ্ছে তেমনি দনন্দিন জীবনেও নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
 
(১) ধূলা দূষণের ফলে স্বাস কষ্ট, যক্ষা, হাপানী, চোখের নানা ধরণের রোগ, ব্রঙ্কাইটিসসহ ধূলার দ্বারা যেসব রোগের জীবানু ছড়ায় সে সব রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। (২) রাস্তার পাশে বা ফুটপাতে অবস্থিত খাবারের দোকানে রাখা খাবারে ধূলা জমছে। এই ধূলার সাথে নানা রোগজীবানুও খাবারে মিশছে ও মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। পাশাপাশি ধূলার কারণে রাস্তার পাশের দোকানের অন্য সকল মালামালের গুণগত মানও ক্ষুন্ন হচ্ছে। (৩) ধূলা দুষণের ফলে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে এগুলো পরিস্কার করার জন্য অলাদা শ্রম ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এবং এগুলোর মেয়াদ কমে যাচ্ছে। (৪) ধূলাদূষণের ফলে পেশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য কাপড়চোপড় বেশি নোংরা হচ্ছে এবং এগুলো পরিস্কার করতেও অধিক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে এবং এগুলোর মেয়াদও কমে যাচ্ছে। (৫) ধূলাদূষণের ফলে শারিরীক পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য রক্ষার জন্যও অধিক শ্রম ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। (৬) শিশু, বৃদ্ধ ও অশুস্থ ব্যাক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষতা কম হওয়ায় ধূলা দূষণের ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ।
 
ধূলা দুষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি ও তার প্রয়োগ পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যে বিয়গ্রুলো আবশ্যক সেগুলো হলো:
(১) প্রতিদিন নিয়মমত রাস্তা পরিস্কার করতে হবে। (২) পরিসেবার সংযোগ মেরামত, বৃদ্ধি ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খননে সৃষ্ট মাটি সম্পুর্ণরুপে সরিয়ে ফেলতে হবে। (৩) দালান-কোঠা বা অন্য কোন অবকাঠামো তৈরীর সময় নির্মান সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় রাখা যাবে না। (৪) নির্মান কাজ ও দালান-কোঠা বা অবকাঠামো ভাঙ্গার সময় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। (৫) এমন কোন সামগ্রী যা থেকে ধূলা সৃষ্টি হতে পারে তা বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। (৬) রাস্তার পাশের ড্রেন পরিস্কার করার সময় ড্রেন থেকে তোলা আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা যাবে না। (৭) সকল আবর্জনা যথাযত স্থানে ফেলতে হবে। (৮) সিটিকরপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে আবর্জনা ছড়িয়ে না পড়ে। (৯) রাস্তা নিয়মিত মেরামত করতে হবে। এবং মেরামতের সময় অধিক সময় নেয়া যাবে না। (১০) ফুটপাত সমূহ নিয়মিত পরিস্কার ও মেরামত করতে হবে। (১১) ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় প্রবেশকরা যানবাহগুলোর যথাযথভাবে পরিস্কার করতে হবে।