বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী দূষণে মৃত প্রায়

বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী দূষণে মৃত প্রায়

ঢাকা মহানগরীর জনস্বাস্থ্যের জন্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ঢাকার চারিপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর পানি দূষণ একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন নদী দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র একটি বিশেষজ্ঞ দল ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং ০১, ০২ ও ০৩ মার্চ ২০১৬ এই ৪দিনব্যাপী উক্ত ৪টি নদীর দূষণ পরীক্ষা এবং দখল-ভরাট পর্যবেক্ষণ করে। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর প্রায় অধিকাংশ স্থানের পানিতে দ্রবীভ’ত অক্সিজেনের মাত্রা শূণ্যের কোঠায়। নদীর দূষিত পানি ব্যবহারের অনপুযোগী হওয়ায় পানির প্রয়োজন মেটাতে আমরা নির্বিচারে ভ’গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছি। ফলে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নীচে নেমে যাচ্ছে। অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবনাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামি ২০ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এখনই সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আজ ০৭ মার্চ ২০১৬, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের আলোকে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পবার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ফেরদৌসআহমেদ উজ্জল, সহ-সম্পাদক প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, পল্লীমা গ্রীণের সদস্য সচিব আনিসুল হোসেন তারেক প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণ একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন নেই বললেই চলে। ফলে মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ নদীগুলো  আজ মৃত প্রায়। ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়নগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এলাকার পয়ঃবর্জ্য এবং গৃহস্থালী বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য, হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য বিশেষ করে টেক্সটাইল ডাইয়িং কারখানা, নৌযান নির্মাণ, মেরামত ও রংকরণ, নৌযান থেকে নির্গত তেল এবং নৌযানের বর্জ্য এসব নদী দূষণের অন্যতম কারণ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন - পবা ২০১৩ সালের জুন মাস থেকে নিয়মিতভাবে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন স্থানের উঙ ও ঢ়ঐ -র পরিমাণ পরীক্ষা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় পবার একটি বিশেষজ্ঞ দল ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং ০১, ০২ ও ০৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে ৪টি নদীর দূষণ পরীক্ষা এবং দখল-ভরাট পর্যবেক্ষণ করে। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন জনস্বার্থে প্রকাশের লক্ষ্যে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।

আমাদের দেশের রাজধানী শহর এবং সংলগ্ন এলাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিশ্বের কোন দেশের রাজধানী  অথবা মেট্টোপলিটন শহরের প্রতি প্রকৃতির এই আর্শীবাদের দৃষ্টান্ত বিরল। চারদিকের এই নৌ-পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। ঘড়ির কাঁটার ঘূর্ণন ক্রমানুসারে নদীগুলো হচ্ছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের চারদিকের এই নৌ-পথের উপর  ১৯৭২ সন হতে মানুষের অনাচার শুরু হয়। এক দিকে দখল এবং অন্যদিকে দূষণের ক্রমবর্ধমান ও অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং পানি দূষিত ও দূর্গন্ধময় হয়ে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির প্রতি মারাতœক বিরুপ প্রভাব ফেলছে।

ঢাকা মহানগরীতে পয়ঃবর্জ্যরে পরিমাণ ১৪ লক্ষ ঘনমিটার। যার মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর পানির গুণগত মানের অবনতি; মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি; শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার অনুপযোগী; জীবানুজনিত দূষণ; মানুষের স্বাস্থ্যের হুমকীর কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার।

হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ হতে দৈনিক ২২,০০০ কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, ইত্যাদি। ট্যানারী হতে নির্গত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য শুধু বুড়িগঙ্গার পানিকেই দূষিত করছে না, নদীর তলদেশ ও উভয় পাড়ের মাটি এমনকি বাতাসকেও ভয়াবহভাবে দূষিত করছে। নদী পাড়ের মানুষগুলো পানি ও বাতাস বাহিত নানারোগে ভুগছেন। ট্যানারীগুলো সাভার ও কেরানীগঞ্জে চামড়া শিল্প নগরীতে সরানোর কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় নদী দূষণ অব্যাহতভাবে চলছে। ট্যানারীগুলো স্থানান্তরের দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের এবং দূষণ মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।

টেক্সটাইল কারখানার বর্জ্যসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার ১লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে পড়ছে। অনেক শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই, আবার যে সব শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধনাগার রয়েছে সে সব শিল্পকারখানা তা পরিচালনা করেন না। ফলে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী অধিদপ্তর কর্তৃক পরীক্ষিত ১৩টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান খুব খারাপ এবং শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীতে কোন প্রাণ বাঁচতে পারবে না। শিল্পকারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।

ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নৌযানের মাধ্যমে যাতায়াত করে থাকে। এছাড়াও নৌযানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মালামাল পরিবহন করা হয়ে থাকে। নৌযানসমূহে সৃষ্ট বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার কোন স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। নৌযানের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের।
ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের এলাকার গৃহস্থালী বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যরে ৪০ শতাংশ যা প্রায় ৩ হাজার টন নালা-নর্দমা, খাল, জলাভ’মি হয়ে নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের।



সংবাদ সম্মেলনে নি¤েœাক্ত করণীয় তুলে ধরা হয়- পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন; গৃহস্থালী বর্জ্য পানি প্রবাহে ফেলা থেকে বিরত থাকা; ট্যানারীগুলো জরুরীভিত্তিতে স্থানান্তর এবং বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন ও বর্জ্য পরিশোধন করা; শিল্পকারখানায় বর্জ্য পরিশোনাগার স্থাপন এবং নিয়মিত তা পরিচালনা করা; নৌযানের ডিজাইনে বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা; বিআইডব্লিউ কর্তৃক নৌযানের বর্জ্য সংগ্রহকরণ ও তা পরিশোনপূর্বক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ; নৌযানের বর্জ্য ও তেল নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকা এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা।