বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ - প্রতিবেশব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃতিতে নদ-নদী, হাওর, পাহাড়, বন, ইত্যাদির ভ’মিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত এগুলো ধ্বংস করে চলেছি। নদ-নদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, দারিদ্র,  অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ু দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, মাএাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভ’গর্ভস্থ পানির অত্যাধিক উত্তোলনে বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে  জীববৈচিত্র্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এপ্রেক্ষিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর উদ্যোগে আজ ০৫ জুন ২০১৭, সোমবার, সকাল ১১টায় পবা মিলনায়তনে আয়োজিত “বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন”-শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
 
পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পবা’র সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, এম এ ওয়াহেদ, মর্ডান ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানত, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বিসিএইচআরডি এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুল হক, পবা’র সদস্য সৈয়দ সাগিরজ্জামান শাকীক, লেডিস ক্লাব এর সদস্য রওশন আক্তার হায়দার, পবা’র সদস্য অমূল্য কুমার বৈদ্য, মো. ইব্রাহীম হোসেন, মোসতারী বেগম প্রমুখ।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান তার মূল প্রবন্ধে বলেন, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, জলাশয় হচ্ছে এদেশের প্রাণ। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং নৌ চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশে ছোট বড় ৩০০ টির বেশী নদী রয়েছে। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সাথে সংশি¬ষ্ট। পদ্মা, মেঘনা, যুমনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। এছাড়াও উজান দেশের সঙ্গে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অনেক অমিমাংসিত বিষয় নিষ্পন্ন না হওয়ার ফলে এ দেশের নদীর ভবিষ্যত অন্ধকার। তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, যুমনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতক্ষ্যা দখল ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। সারা দেশের নদীগুলো দখল-ভরাটে নিস্তব্ধ, ¯্রােতহীন এবং দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ আজ মারাত্বক হুমকির সম্মুখীন।অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বাঁধ নির্মাণসহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে নদী বাহিত পলি প্রবাহের কারণে পানি সাগরে যেতে না পারায় নদীর তলদেশ ভরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে নদীর নব্যতা। দেশের প্রায় ১৪০ টি নদ-নদী এখন মৃত প্রায়। দেশের প্রায় ১৩টি নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানচিএ থেকে হারিয়ে যাবে এসব নদী। 
 
জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে কৃষি জমি। কৃষি জমি কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। প্রতিবছর ৬৮,৭৬০ হেক্টর চাষাবাদ যোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছেদেশে বর্তমানে ৮.৫২ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি রয়েছে। ১৯৭৬ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯.৭৬২ মিলিয়ন হেক্টর। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর বৈশিষ্ট হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমুল পরিবর্তন ঘটছে। 
 
জমির অতিকর্ষণে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। টপসয়েলের আস্তরণ কমে যাচ্ছে। একই জমি বারবার চাষ করার ফলে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশীয় ধানের জাত ১৯৮২ সালে ১২৪৮৭টি, ২০১৪ সালে ৭০০০টি (বিএআরআই) রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ইরি চাষের জন্য প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এতে ১২০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজর হয়। সেচের পানি ভূ-গর্ভ ও ভূ-পৃষ্ঠ দু উৎস থেকেই আসে এবং খাল-বিল, নদ-নদী শুকিয়ে যায়। দেশের অনেক জায়গায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় উত্তোলনে এবং সেই র্ভূ-গর্ভস্থ পানির অপর্যাপ্ত পরিপূরণে ভূ-গর্ভস্থ পানির  স্তর আহরণ ক্ষমতার নীচে নেমে যাচ্ছে। দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিগত ৩০ বছর (১৯৮১-২০১০) বার্ষিক গড় ১.৪% হারে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে বেশী নেমেছে রাজশাহীতে।
বনজসম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী বৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে প্রায় ৯৮২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিচরণ করে। এর মধ্যে ৫৩ প্রজাতির উভচর, ১৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৫০ প্রজাতির পাখি এবং ১২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। উভচর প্রাণীর অধিকাংশই ব্যাঙ। গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলাদেশ ব্যাঙের পা রপ্তানি করে কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করে। ব্যাঙ ক্ষতিকর ৪৫ ধরনের পোকা-মাকড় খেয়ে থাকে। সরীসৃপ প্রাণীর ৩০ প্রজাতির কাছিমের প্রায় সবগুলোই বিপনেরœ তালিকায়। বাংলাদেশে ২ প্রজাতির কুমির দেখা যায়। একটি লোনা পানির কুমির, অন্যটি ঘড়িয়াল। মিঠাপানির কুমির প্রায় সব নদীতে ছিল, যা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে এবং ৪০ প্রজাতি স্তন্যপায়ী, ৪১ প্রজাতি পাখি, ৫৮ প্রজাতি সরীসৃপ ও ৪ প্রজাতি উভচর প্রাণী হুমকীর সম্মুখীন। গত ৪০ বছরে মধুপুর শালবনের ৮৫ শতাংশ ধ্বংস করা হয়েছে। চিংড়ি চাষের নামে চকোরিয়া ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
 
বিশ্বের একক সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বাংলাদেশের সুন্দর বন। বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস সুন্দরবনে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু এবং সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখছে। প্রায় ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, বনজ সম্পদের নির্বিচার আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার, ইত্যাদি কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববেচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন সুন্দরবন। সুন্দরবনকে রক্ষা করে বাঘ (২০০৪ সালে ৪৪০টি, ২০০৬ সালে ২০০টি, ২০১৫ সালে ১০৬টি)। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন। 
 
হাওর এলাকা প্রায় ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৩৭৩টি হাওর/জলাভ’মি রয়েছে। এ সকল হাওরের জৈব বৈশিষ্ট্যসমূহ দৃশ্যত অনন্য ও আকর্ষণীয়। অতীতে হাওর অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র ছিল অতি সমৃদ্ধ। কিন্তু পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে প্রাণবৈচিত্রের এই প্রাচুর্য বর্তমানে ক্রমক্ষয়িষ্ণু।
 
ঢাকা মহানগরীতে অধিক হারে ভ’গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই ভ’গর্ভে পানির শূন্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহানগরীতে যেখানে ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলক’প ছিল, বর্তমানে তা প্রায় ৭০০টি। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর পানির স্তর ১০ ফুট করে নিচে নামছে। ভ’গর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে ২০ থেকে ৩০ বছর পর  মিঠা পানির অভাবে ঢাকায়  জনশূন্যের পাশপাশি ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। ঢাকায় জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল-এর পরিমান ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে  যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে  যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল যথাক্রমে ৩২.৫০% ও ৫২.৫০% হ্রাস পেয়েছে। জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল ভরাট ও দখলের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে এবং নগরবাসী প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধার শিকার হচ্ছে।
 
করণীয়
ক্স পানি সম্পদ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। 
ক্স নদ-নদী দখল-ভরাট- দূষণমুক্ত করা এবং খননের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধিপূর্বক পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো।
ক্স যেসব এলাকায় পানির অভাব রয়েছে, সেসব এলাকায় ইরি চাষ পরিহার করে দেশীয় জাতের ধান চাষ করা।
ক্স প্রকৃতি নির্ভর দেশীয় জাতের ধানের ফলন বৃদ্ধির  লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ক্স উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় মাছের চাষ করা এবং এসব মাছের ফলন বৃদ্ধির  লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ক্স নির্বিচারে বনভ’মি উজাড় রোধ এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা।
ক্স ভ’গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ব্যবহার করা।
ক্স জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ পাহাড় ও হাওর প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।