‘পাহাড়সমূহ জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে’
প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড় ধস ও পাহাড়ী ঢলে মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। প্রকৃতির সাথে কিছু লোভী মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের ফলেই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পাহাড় ধস যেন একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাহাড় ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরও সরকারের পক্ষ হতে এর যথাযথ প্রতিকার দেখা যাচ্ছে না। পাহাড় ধস প্রতিরোধের বিষয়ে গত দুই দশক ধরে যথেষ্ট আলোচনা ও সমালোচনা হলেও  কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, পাহাড় কোন ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি নয়। এটি প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পূর্ণ জাতীয় সম্পদ। এমতাবস্থায় আজ ০৮ জুলাই ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র উদ্যোগে ‘পাহাড় রক্ষা - মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে ‘পাহাড়সমূহ জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা’র দাবী জানানো  হয়।
 
পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলন (পবা)-ও সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে এবং পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবা’র সম্পাদক শামিম খান টিটু, পবা’র সহ-সম্পাদক মো. সেলিম ও ব্যারিষ্টার নিশাত মাহমুদ, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী ও কায়সার আহমেদ, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হক, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-এর প্রকল্প কর্মকর্তা আতিকুর রহমান, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পি, নিরাপদ পানি চাই আনোদালনের সভাপতি প্রকৌশলী মো: আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিগত প্রায় চার দশকে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় ধসের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রতি বছরই প্রাণহানী ঘটছে। ২০১৭ সালের ১২ জুন চট্রগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় পাহাড় ধসে ১৬২ জন প্রাণ হারান, ৪ শতাধিক আহত হন। জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি রাঙ্গামাটি দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্রগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জন প্রাণ হারান। ২০০৭ সালে তাৎক্ষণিকভাবে গঠিত কমিটি কর্তৃক ৩৫টি সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও পাহাড় ধস প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনায় বিগত এক দশকে কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। ফলশ্রুতিতে এবারের মহাবিপর্যয়। যাতে ব্যাপক প্রাণহানী, অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। পাহাড় রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এখনই মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা আবশ্যক। অন্যথায় আমাদেরকে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। চট্রগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলোর গঠন প্রকৃতি বালিযুক্ত, দোআঁশ, বালিময়। এধরনের পাহাড়ে টানা ২০০ মিলিমিটারের উপরে বৃষ্টিপাত হলে এগুলোতে ধস নামে। পাহাড় ধসের মাত্রা ও গতি বেড়েই চলেছে এবং বিপর্যস্ত এলাকার বিস্তৃতিসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের ফলশ্রুতিতে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনিক উদাসীনতা। 
 
তিনি আরো বলেন, পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হলেও থেমে নেই পাহাড় কাটা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ লক্ষ্যই করা যায় না। ভ’মিদস্যুরা পাহাড় কেটে ক্ষতবিক্ষত করে রাখে। ফলে দেশে পাহাড় ধসের ঘটনা এখন একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় কাটার কারণে বৃষ্টির সময় পাহাড়ের বালিগুলো ড্রেনে নেমে আসে এবং এতে ড্রেনের স্বাভাবিক প্রবাহ  বাধাগ্রস্থ হয়। যার ফলে নগরীতে জলাবদ্ধতা চরম আকার ধারন করে। তাছাড়া পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে। পাহাড় ধস মনুষ্য সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অনেক বছর ধরেই পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় কেটে বসতি ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এক ধরনের অসৎ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পাহাড়ের গাছপালা কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে ও পাহাড়ের নিচের মাটি কেটে পাহাড়কে দিনে দিনে ঝুঁকিপূর্ণ ও ধবংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের নিচের মাটি কাটার ফলে পাহাড়ের ওপরের ভার নিচের দিকে চাপ দেয়। এ অবস্থায় একটানা দু-তিন দিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। এ সময়  পাহাড়ের গায়ের স্থাপনাসমূহ মাটি আকড়ে ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বসবাসরত স্থাপনা ভেঙ্গে নিচে পড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড় ধস ও পাহাড়ী ঢলে মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। প্রকৃতির সাথে কিছু লোভী মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের ফলেই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পাহাড় ধস যেন একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাহাড় ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরও সরকারের পক্ষ হতে এর যথাযথ প্রতিকার দেখা যাচ্ছে না। পাহাড় ধস প্রতিরোধের বিষয়ে গত দুই দশক ধরে যথেষ্ট আলোচনা ও সমালোচনা হলেও  কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাহাড় ধস ও পাহাড় ধসের মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে হলে পাহাড় রক্ষার ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। চট্রগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার জেলা মূলত পাহাড় ঘেরা প্রকৃতি নিয়ে সজ্জিত। এসব পাহাড়ী এলাকার বন-জঙ্গল উজাড়, পাহাড় কেটে সমতল করে বসতবাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। এছাড়াও অপরিকল্পিত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, ইকোটুরিজম, কৃষি উৎপাদন, রাবার চাষের নামে বৃক্ষ নিধন চলছে। এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে দেশে পাহাড় থাকবে কিনা তা বলা বড়ই মুশকিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। 
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, ইত্যাদির বিরুপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমুল পরিবর্তন ঘটছে। গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়েছে যে কোন মৌসুমের ক্ষেত্রে, বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলে গেছে। সাম্প্রতিক কালে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধসের বর্ধিত আনাগোনা ও প্রচন্ডতায় বাংলাদেশের জনজীবন, কৃষি, ভৌত অবকাঠামো অহরহই বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় দেশে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সাম্প্রতিককালে একটার পর একটা সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। হাওরের বিপর্যয়ের পর ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ এবং তৎপরবর্তী পাহাড়ী ঢল ও ধস। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সীমিত আয়তনের জনবহুল এদেশে পরিবেশ বিপর্যয়রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরী। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন।
 
 
করণীয়ঃ
ক্স প্রকৃতি প্রদত্ত পাহাড়সমূহ জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা।
ক্স পাহাড়ের গঠন প্রকৃতি, বৃষ্টিপাতের মাত্রা ও পরিমাণের ভিত্তিতে পাহাড়গুলোকে সতর্ক, ঝুঁকিপূর্ণ, চরম ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীতে বিন্যাশ করা এবং তার আলোকে জনগণকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
ক্স পাহাড় কাটা প্রতিরোধে অবিলম্বে সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করা। 
ক্স পাহাড়ের অবৈধ দখলদার, ভ’মিদস্যু তথা ডেভেলপার ও রিয়েল এষ্টেট কোস্পানিসহ পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত ও সহযোগিতাকারীদের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান। 
ক্স ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ জায়গায় বসবাসের জন্য জরুরীভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।
ক্স প্রতিবেশের হুমকি ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সাইট নির্ধারণ এবং ইকোটুরিজম ও কৃষি কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ক্স এখনই পাহাড়ের গাছপালা ও মাটি কাটা বন্ধ করা।
ক্স জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ পাহাড় প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।