#আমাদের কৃষি ও পরিবেশের প্রয়োজনে জলাভূমি সংরক্ষণ ও সুরক্ষা করতে হবে
জলাভূমি জনপদের সঞ্জীবনী, প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদ এবং জীব-বৈচিত্রের আধার। কিন্তু জলাভুমির এ্ই পানি প্রকৃতির অফুরন্ত দান নয় বরং একটি সীমিত সম্পদ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বিশ্ব জলাভূমি দিবস ২০২১ উপলক্ষ্যে আজ ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সকাল ১১টায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে আমাদের কৃষি ও পরিবেশের প্রয়োজনে পানি সম্পদ ও জলাভূমি সুরক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ১৩টি দাবি উত্থাপন করে।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান, পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহেমদ উজ্জল, ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটির চেয়ারম্যান মো: হুসাইন, সিনিয়র সহ-সভাপতি মো: আ: বাতেন সরকার. হিল এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জেবুন নেছা, মার্শাল আর্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আতিক মোর্শেদ, গ্রীন ফোর্সের সদস্য ওবায়দুল ইসলাম, নাসফ এর সহ সম্পাদক মো: সেলিম, বিসিএইচআরডি এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ নদী বাচাঁও আন্দোলনের সম্পাদক মো: শাকিল রেহমান, প্রচার সম্পাদক হাসিবুল হক পুনম, পুরানো ঢাকার সংগঠক শেখ আনসার আলী, নাজিমউদ্দিন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ সংসদ এর আবু সাদাত মো: সায়েম প্রমূখ। মানববন্ধনে সঞ্চালনা করেন পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হাসান মামুদ।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের জলাভূমিগুলি আজ তীব্র সঙ্কটের মুখে। জলাভূমিকে বাস্ততন্ত্রের কিডনি বলা হয়। ক্রমবর্ধমান ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে জলাভূমি ধ্বংসের কারণে ইতোমধ্যে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, জলকেন্দ্রিক জীবনচক্র ও বাস্তসংস্থানের জন্য যা অশনিসংকেত। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন কোনো না কোনোভাবে এইসব জলাভূমির অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। বিপন্ন জলাভূমির উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ পরিবারের জীবন-জীবিকা। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, জলাভ’মিগুলো দেশের মোট জমির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত। জলাভূমির আয়তন কমে এখন ৪৫ দশমিক ৮৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভ’মি ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলনিষ্কাশন ও সেচে’ হারিয়ে পিয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। কৃষি এবং কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড। বাংলাদেশ কৃষি পরিসংখ্যান তথ্য অনুসারে দেশের মোট আবাদী জমির পরিমাণ ৮৫.৭৭ লক্ষ হেক্টর যার মধ্যে ৭৪.৪৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ এর মাধ্যমে কৃষিকাজ চলমান। এই সেচ এর প্রায় ৭৮% শতাংশ পুরোপুরি ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে মাটির উপরে পানির বিভিন্ন উৎসের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, হ্রদ ও জলা, হাওর, বাঁওড়, খাল, বিল, ঝিল, দীঘি, পুকুর, প্লাবিত কৃিষজমি, পরিত্যক্ত নদীখাত, শুকনো নদীপৃষ্ঠ, খাড়ি, ঝর্ণা ও ¯্রােতজ বা গড়ান জলাভূমি। দখল ও দূষণের কারণে পানির আধার ধ্বংস হয়ে পানি সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাভূমি কমে যাওয়ায় ভূগর্ভের পানির স্তর ক্রমেই নিচে চলে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জ হচ্ছে না। পানির স্তর ভয়াবহ পরিমানে নেমে শুকনো মৌসুমে আমাদের দেশের সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। পানির অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এ জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। কৃষি উন্নয়নের জন্য পানি সম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য।
সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়-জলাশয়গুলো বাংলাদেশের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তনের করাল গ্রাস থেকে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। জলাভূমির বিপন্নতার জন্য বিশেষজ্ঞরা যে তিনটি বিষয়কে মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন-সেগুলো হলো- জলবায়ু পরিবর্তন, দখল-দূষণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রচেষ্টা। পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি, বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা, ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের প্রভাব-নির্ভর সিদ্ধান্ত, দূর্বল তদারকি, অনিয়ম এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাংলাদেশে জলাভূমি দখল বেড়েছে, জলনির্ভর জীববৈচিত্র্য ব্যাপক ঝুঁকির কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে জলাভূমি সমৃদ্ধ ১৩টি এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণা করেছে। ২০১১ সালে সংবিধানে ১৮ ক অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে জলাভূমি সংরক্ষণের রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।
প্রকৃতি ও পরিবেশ নষ্টের মতো জলাভূমি ধংসের মূলে আছে মানুষের ‘অবিমৃশ্যকারিতা’ ভাবনা, র্অথাৎ ‘অগ্র-পশ্চাৎ না ভাবিয়া কাজ করা’। জলাভূমি ভরাটসহ নানাভাবে জলাশয় দূষণের মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে নিজেদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছি। জলাভূমিগুলি না বাঁচলে, পরিবেশ-প্রতিবেশ ভারসাম্য বিপন্ন হলে আমরা ভাল থাকবো না। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই জলাভূমিগুলি রক্ষা করতে হবে। সুরক্ষিত রাখতে হবে পরিবশগত ভারসাম্য। সরকারের ভূমিকা মুখ্য হলেও সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় সর্মথন ও স্বতঃপ্রণোদিত ভূমিকা ছাড়া এ কাজে সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে জলাভূমি রক্ষা করা সম্ভব নয়। এ জন্য জলাভূমিকেন্দ্রিক এমন কিছু প্রকল্প নেওয়া দরকার, যাতে সেগুলো থেকে স্থানীয় জনগণ সরাসরি লাভবান হতে পারে। তাহলে নিজ স্বার্থেই তারা জলাভূমি রক্ষায় উদ্যোগী হবে। দেশে জলাভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নীতিমালার অভাব রয়েছে। আমাদের সুপারশিসমূহ:
১. দেশের হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, নদ-নদী, প্লাবনভূমি প্রভৃতি জলাশয় ও পানি সম্পদকে দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে।
২. দেশের সকল জলাভূমির তথ্যভান্ডার তৈরী ও সংরক্ষণ করিতে হইবে।
৩. দেশের সকল পানি সম্পদের পরিবেশসম্মত ব্যবহার নিশ্চিত এবং বর্ষায় প্রাপ্ত পানি সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হইবে।
৪. সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতি অবলম্বন করতে হবে, জলাভূমি সংরক্ষণ ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করতে সকল অংশীজনের বিশেষ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে পানি সম্পদের পরিবেশ সম্মত ব্যবহার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বাঁধনির্মাণ, নদ-নদী, খাল-বিল বা জলাশয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থা যাতে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে পরিবেশসম্মত হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
৬. পানির সহজলভ্যতা বাড়াতে নদ-নদী, জলাশয় ও খাল খনন/সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীভাঙ্গন ও অকাল বন্যা রোধকল্পে অববাহিকা এলাকায় ব্যাপক বনায়ন করতে হবে।
৭. অবক্ষয়ের কারণে কোনো জলাভূমি নাজুক হলে সেটি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ) এলাকা ও সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। ইসিএ এলাকা কোনভাবেই লীজ দেওয়া যাবে না।
৮. জলাভূমির জলজীবন সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা তৈরী ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৯. সকল সড়ক ও রেলপথের পরিকল্পনাতে অবাধ পানি চলাচল করবার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০. পরিবেশগত ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য জলাভুমি ভিত্তিক জনপ্রিয় পর্যটন এলাকায় বছরের কোনো কোনো সময় পর্যটন সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ অথবা সীমিত করতে হবে।
১১. জলাভূমি সুরক্ষার বিষয়ে গণসচেনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
১২. জলাভূমি সংরক্ষণ জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৩. বাংলাদেশের নদী ও জলাভূমি বাঁচানোর জন্য ‘নদী জলাভূমি দখল ও দূষণ প্রতিরোধ আইন’ জারি করতে হবে।