করোনা বাস্তবতায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা রক্ষা ও পুনরুদ্ধার চ্যালেঞ্জসমূহ

ধরিত্রী দিবসে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের দাবিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা’র আয়োজনে আজ ২২ এপ্রিল ২০২১ বেলা ৩.০০ টায় অনলাইনে জুম প্লাটফর্মে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক মেসবাহ সুমনের সঞ্চলনায় আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে এবং এসব উন্নয়ন করতে যেয়ে আমাদের ইকোসিস্টেম এর বেইজ কে ধংস করে দিচ্ছি। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে যেয়ে জলাধার ধংস করে ফেলছি। নদীর গতি পরিবর্তিত হয়েছে। যার ফলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুকির সম্মুখীন হয়েছে। বায়ুদূষণ এর কারণে ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক ঝুকিতে আছে।

বক্তারা আরও বলেন, দেশের নদী ও জলাধারসমুহ শেষ হয়ে যাচ্ছে, মৃত ও ভরাটকৃত নদী-জলাশয় হয়তো ফিরাতে পারবোনা, কিন্তু কৃষি উৎপাদন কে প্রাকৃতিকভাবে উন্নত করতে পারি। নদীর দুষন রোধ করতে পারি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নদী দখল, দূষণ হচ্ছে, ভরাট হচ্ছে। যারা এসব অবৈধ কাজ করছে, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। যারা আইন অমান্য করছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদান করেন প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাধারণ সম্পাদক, পবা। ডা. লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক,পবা। পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, বানিপার সাধারণ সম্পাদক এম ওয়াহেদ প্রমূখ।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পেছনে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশি দায়ী। কারণ, পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের সমন্বয়ে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তার একটি উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য সামগ্রিকভাবে বিনষ্ট হয়। পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষা সমন্বয় করা। আমাদের পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট আইন রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কাজ আইনগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা দেখি পরিবেশ রক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাদের যে তদারকির ভূমিকা নেওয়ার কথা, সেখানে ঘাটতি রয়েছে। এর ফলাফল আমরা দেখি, দূষণের বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, করোনা আমাদের বড় সংকেত দিয়েছে সেটা হলো সভ্যতার হ্রাস টেনে ধরতে হবে,প্রকৃতির সাথে মানিয়ে আমাদের কর্মকান্ড কে তৈরি করতে হবে। ইকোসিস্টেম কে ভাঙা যাবেনা। জড় বস্তুর বিন্যাস তাকেও ভাঙা যাবেনা। বিজ্ঞান এবং পরিবেশের সূত্র অনুযায়ী যেভাবে পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষা করা যায় সেভাবে প্রকৃতির পাশে দাঁড়িয়ে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশ প্রতিবেশ এবং বাস্তুসংস্থান এর স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিন্তু একই সাথে পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম বজায় রেখে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন ‘পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়ন নীতি’। ‘ইকো-সিস্টেম'-এর ক্ষতি করে যে ‘প্রবৃদ্ধি' আসে তা আসলে ‘টেকসই উন্নয়ন' নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য, অর্থনৈতিক স্থিতি অর্জনের জন্য একমাত্র পরিবেশ-বান্ধব নীতি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমাদের জীব বৈচিত্রের আধার হলো বন জংগল, যার ধংসের ফলে ইকোসিস্টেম ধংস হচ্ছে। পাহাড় ধংস করে পানির ধারা ধংস হচ্ছে, গাছপালা ধংস হচ্ছে, গাছপালা বিনষ্টের ফলে বিভিন্ন পশু-প্রাণি ধংস হচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্প দূষণের ফলেও ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদেরকে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনে ও ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উপর জোর দিতে হবে। আর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নিজেদের অশেষ ভোগের বাসনা। যদি তা না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে আসবে আরো কঠিন দিন। আমরা এখনি দেখতে পাচ্ছি খরা ও বন্যা, নদী ভাংগন আমাদের বিপর্যস্ত করে তুলছে; জলবায়ু শরণার্থীরা তাদের বাড়িঘড় ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজছে। করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো এই পরিবর্তিত পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয়া। যারা পরিবেশকে অশান্ত করেছে তারা পরিবেশকে শান্ত রাখতে নিজেদের বিলাসী জীবনের একটা সীমা নির্ধারণ করবে এটাই কাম্য। ’আর্থ ডে’ বা ধরিত্রী দিবস কে আমরা শুধুই উদযাপনের জন্য না রেখে যদি সংকল্প করি, দায়িত্ব গ্রহণ করি ও পরিবর্তনের জন্য কাজ করি তবে আমাদের পৃথিবী পুনরুদ্ধার হবে।

পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে আলোচনা সভা থেকে নিম্নোক্ত চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়:

  • নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বাঁচবে এ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। কৃষি, মৎস্য চাষ, শিল্পকারখানা ও কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা। পাওয়া যাবে সুপেয় পানি। চর পড়ে এবং দখল-দূষণের কারণে নদ-নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। নদীর নাব্যতা, দখল, দূষনরোধ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  • বনের প্রতিবেশব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। দেশের বনাঞ্চল দখল রোধ, দখলী স্থান উদ্ধার এবং বনাঞ্চলে প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণ ও বৃক্ষ নিধন বন্ধ করার জন্য কঠোর পন্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
  • প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের পরিবেশসম্মত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে, যা এবং সমাজের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করে। সমাজের সুষম পরিবেশসম্মত উন্নয়নের কাজটি বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ।
  • পরিবেশ রক্ষায় ​যে বিধিবিধান প্রয়োগের কথা, তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না অথবা প্রয়োগে আন্তরিকতা লক্ষ করা যায় না। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। নীতিনির্ধারক, প্রশাসক, বাস্তবায়নকারী সংস্থা ​এদের সবার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় করে কাজ বাস্তবায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  • সকল প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার জনগণের অংশগ্রহণে টেকসই জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা।
  • পরিবেশ দূষণের পরিণাম সম্বন্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, পরিবেশ বান্ধব ব্যক্তিগত অভ্যাস তৈরী জন্য পরিবেশ ও জলবায়ু লিটারেসি বাস্তবায়ন করা