আজ সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নির্বাচনী অঙ্গীকার শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের দরোজায় কড়া নাড়ছে আরো একটি জাতীয় নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনমনে বিপুল প্রত্যাশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচনকালীন সময়ে তাদের আশা- আকাঙ্খার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ পায়। দেশের মানুষের সম্মুখে রাজনৈতিক দলসমুহ তাদের ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তুলে ধরে। বর্তমান বৈশ্বিক এবং স্থানিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের টিকে থাকা,সুস্থতা ও উন্নয়নের জন্য জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিষয়টি অনুধাবন করেই আমাদের আজকের আলোচনার অবতারণা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), জনউদ্যোগ ও ডক্টরস ফর হেল্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর যৌথ আয়োজনে পবার চেয়ারম্যান জনাব আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. লেলিন চৌধুরী। জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব তারিক হেসেনের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ও ডক্টরস ফর হেল্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি প্রফেসর ডা. আবু সাঈদ, জনউদ্যোগের জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ডা. মুশতাক হোসেন, পবার সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহান, স্ট্যামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কামরুজ্জামান, ঢাকা ৭ ও ৮ আসনে বাসদ মনোনীত গণতান্ত্রিক বাম জোট প্রার্থী কমরেড খালেকুজ্জামান লিপন ও কমরেড শম্পা বসু, ডা. এমদাদুল হক, হরেন্দ্রনাথ সিং, মাহবুল হক, মো. জাকারিয়া প্রমুখ।
সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের উপর ‘এমিশন গ্যাপ রিপোর্ট-২০১৮’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে ২০১৭ সালে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ ১.২% বেড়ে গিয়েছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা শিল্প যুগের আগের তুলনায় ১.৫ সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে ধরে রাখা। এই লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ বর্তমানের তুলনায় ৫৫% কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বর্তমানে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ যে হারে বাড়ছে তাতে বর্তমান শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যতোটা বাড়বে তাতে পৃথিবীর প্রায় আশি ভাগ ভূখন্ড সম্ভবত তলিয়ে যাবে । আগের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর প্রথম কয়েকটির একটি হবে বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় ধূলি দুষিত নগরী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশের বনাঞ্চল ১০% (থাকার কথা দেশের মোট আয়তনের ২৫%)-এ নেমে এসেছে। সারা বিশ্বে যেখানে কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহারের হার ২২% সেখানে বাংলাদেশে এই হার হচ্ছে ৩৯%। দেশব্যাপী দখল হয়ে যাচ্ছে নদ- নদী, খালবিল, ডোবানালা, জলাধার এবং চাষের জমি। বায়ু দুষণ, জল দুষণ, ভূমি দুষণ, শব্দ দুষণ, আলো দুষণ, প্লাস্টিক দুষণ , খাদ্য দুষণসহ নানারকম দুষণের প্রকোপে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যমান ক্রমশঃ নিম্নগামী হচ্ছে। তাই সম্প্রতি প্রকাশিত মানব পুঁজি(ঐঁসধহ ঈধঢ়রঃধষ)-র তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৬১ তম। মানব পুঁজির নির্ণায়কগুলো হচ্ছে- কৃশতা, খর্বতা, রক্তস্বল্পতা,বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা,দৃষ্টিস্বল্পতা, শ্রবনস্বল্পতা এবং রোগ সংক্রমণ প্রবনতা। সবমিলিয়ে দেশে মানুষের রোগ এবং ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে। দেশে প্রতি বছর আড়াই লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী সনাক্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দুই কোটির বেশি। যাদের মধ্যে আট লাখ রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। দেশের ৫ - ৬% মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত(এসোসিয়েশান ফর স্টাডি অব লিভার)। ডায়াবেটিস রোগে বিশ্বে দশম স্থানে বাংলাদেশ। এভাবে তালিকা দীর্ঘতর করা যায়।
আইন থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ বিধ্বংসী, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ভেজাল বিষযুক্ত এবং অনিরাপদ খাদ্যের বন্যায় দেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এমতবস্থায় জনমানসে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে ‘দেশের আইন কেতাবে আছে প্রয়োগে নাই’।
চারঃ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা, ঘোষণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করার জন্য আমরা কয়েকটি দলের ২০০৮ এবং ২০১৪-র নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করি। এরমধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)-র ইশতেহারকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এসব ইশতেহার পাঠ করে পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারি ঃ-
১. প্রতিটি রাজনৈতিক দল অনুধাবন করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
২. রাজনৈতিক দলগুলো স্বাস্থ্যসেবা বলতে প্রধানত চিকিৎসাসেবা বুঝে থাকে।
৩. মানুষের সুস্বাস্থ্যের সাথে গবাদিপশুসহ অন্যান্য প্রাণী, কৃষি-উদ্ভিদসহ সকল বৃক্ষাদি এবং মাছসহ সব জলজ
প্রাণীর সুস্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত -- এই বিষয়টি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল উপলব্ধি করে না।
৪. আধুনিক পৃথিবীতে উন্নয়ন শুরু হয়েছিল ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পথ ধরে। কিন্তু সে উন্নয়নের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ফলে বিশ্ব এখন এক মহা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এখনকার ভাবনা হচ্ছে- প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্যকে আহত/ক্ষতিগ্রস্থ না করে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন। কিন্তু আমাদের ধারণা হয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নবতর উন্নয়ন ভাবনাকে আত্মস্থ করতে সমর্থ হয় নাই।
জলবায়ু পরিবর্তনের দরুণ দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে জেনেও সরকারগুলো তেমন দৃশ্যমান কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করে নাই। বরঞ্চ প্রতিটি সরকারের আমলে বন উজাড়, নদী-নালা-জলাভূমি দখল, নদী ভরাট করা ইত্যাদি চলমান থেকেছে। অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রনয়নের মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে একই সরকার রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপন শুরু করার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন বিনাশী একটি মহানিন্দনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। যেখানে সারা বিশ্ব শ্লোগান তুলেছে (কয়লা নয়) অর্থাৎ কয়লা নিষিদ্ধ কর। কারণ কয়লা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। কিন্তু দেশে কয়লা-তাপ ভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনের হিড়িক পড়েছে যেন। সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ লোকজন মনে করে ‘রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ভালো/কল্যাণকর কথা যা বলে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলোর বেশির ভাগ ভুলে যায়।’
সেমিনারে বক্তারা বলেন, সংসদে যারা নির্বাচিত হন তারা কেন এসব স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের কাজে নাক গলাবেন এ প্রশ্ন তুলে বক্তাগণ বলেন, সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো নির্দ্দিষ্ট এলাকার ভোটার নয়, বরং বাংলাদেশের যেকোনো এলাকার ভোটার হলেই চলে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হলে নির্দ্দিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হয় কেনো এ প্রশ্ন আজ করার সময় এসেছে। তারা সংখ্যানুপাতিক আসন বন্টনের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এতে নির্বাচনী আচরণ ও নির্বচিনী পরিবেশ অনেকটা শান্তিপূর্ণ হতে পারে।
বক্তাগণ আসন্ন নির্বাচনে প্রচারেরে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও জোট সমূহকে পরিবেশ আইন মেনে চলার দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেবার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা এই পরিবেশের উপর বিশেষ নজর দিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।
সকল দল ও জোট যাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশকে সবার আগে স্থান দেন এবয় যুবসমাজকে যুক্ত করে এর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেন এবং তা পরবর্তী সময়ে যারাই সরকার গঠন করুকনা কেনো তারা যেনো এ বিষয়টি প্রতিপালন করেন সে বিষয়ে আমরা নজর রাখার বিষয়ে অভিমত ব্যাক্ত করেন এবং আগামী সরকারের একবছর পূর্তিতে তার কতটা করা হলো বা হলো না তা বিশ্লেষণ করা হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না হলে সমাজটা ভালো হবে না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মানসিক বিকাশ এবং শিশুকাল থেকেই তার চিন্তাশক্তি সুস্থ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য সকলের এক হয়ে কাজ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন বক্তাগণ।
বর্তমান ব্যবস্থায় প্রদর্শণবাদের কারণে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য আজ রোগাক্রান্ত উল্লেখ করে তারা বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও জোটসমূহ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে জনগণকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রদান করবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন। এই প্রদর্শণবাদ থেকে সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রাকৃতিক, সামাজিক ও মানবিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পবিবেশের সকল বিভাগেই আজ অরাজক পরিস্থিতি বিরাজমান।
ঢাকাসহ সারা দেশের খাল-বিল-নদী দখল ও দূষণের আজ বিলিন হবার পথে। পরিবহন ক্ষেত্রে আমরা সড়ক পথকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশকে মারাত্মক হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছি। অথচ রেল ও নৌপথে পরিবহন সুবিধা অনেক। এতে ধুলাদূষণ, শব্দদূষণ ও পরিবহন ব্যায় সড়ক যোগাযোগের তুলনায় অনেক কম।
গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশের মানুষের যা যা বৃদ্ধি হবার কথা ছিলো তার প্রত্যেকটি কমেছে, আর যেসব ক্ষেত্রে কমার কথা তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যানবাহনের গতি কমে শহরে এখন ৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। শব্দ দূষণে মারাত্মকভাবে শিশুসহ সকল বয়সের মানুষের শ্রবনশক্তি কমে যাচ্ছে। ইটিপি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নানা প্রশ্ন জনমানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
বর্তমান সময় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সময়। এসময় কেবল সাধারণ ভাবেই সব ভাবলে চলবে না উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, আমাদের দেশের আইন প্রণয়ণ ও নীতি নির্ধারণের জন্য জাতীয় সংসদ। এখানে আলোচনায় শতকরা মাত্র দশভাগ আলোচনা হয় আইন ও নীতি নিয়ে। বাকি কথা হয় এলাকার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, ভবন ইত্যাদি ক্ ‘নির্বাচনী অঙ্গীকারে প্রাণ-প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে ’
আজ সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নির্বাচনী অঙ্গীকার শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের দরোজায় কড়া নাড়ছে আরো একটি জাতীয় নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনমনে বিপুল প্রত্যাশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচনকালীন সময়ে তাদের আশা- আকাঙ্খার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ পায়। দেশের মানুষের সম্মুখে রাজনৈতিক দলসমুহ তাদের ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তুলে ধরে। বর্তমান বৈশ্বিক এবং স্থানিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের টিকে থাকা,সুস্থতা ও উন্নয়নের জন্য জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিষয়টি অনুধাবন করেই আমাদের আজকের আলোচনার অবতারণা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), জনউদ্যোগ ও ডক্টরস ফর হেল্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর যৌথ আয়োজনে পবার চেয়ারম্যান জনাব আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. লেলিন চৌধুরী। জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব তারিক হেসেনের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ও ডক্টরস ফর হেল্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি প্রফেসর ডা. আবু সাঈদ, জনউদ্যোগের জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ডা. মুশতাক হোসেন, পবার সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহান, স্ট্যামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কামরুজ্জামান, ঢাকা ৭ ও ৮ আসনে বাসদ মনোনীত গণতান্ত্রিক বাম জোট প্রার্থী কমরেড খালেকুজ্জামান লিপন ও কমরেড শম্পা বসু, ডা. এমদাদুল হক, হরেন্দ্রনাথ সিং, মাহবুল হক, মো. জাকারিয়া প্রমুখ।
সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের উপর ‘এমিশন গ্যাপ রিপোর্ট-২০১৮’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে ২০১৭ সালে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ ১.২% বেড়ে গিয়েছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা শিল্প যুগের আগের তুলনায় ১.৫ সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে ধরে রাখা। এই লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ বর্তমানের তুলনায় ৫৫% কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু বর্তমানে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ যে হারে বাড়ছে তাতে বর্তমান শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যতোটা বাড়বে তাতে পৃথিবীর প্রায় আশি ভাগ ভূখন্ড সম্ভবত তলিয়ে যাবে । আগের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর প্রথম কয়েকটির একটি হবে বাংলাদেশ।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় ধূলি দুষিত নগরী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশের বনাঞ্চল ১০% (থাকার কথা দেশের মোট আয়তনের ২৫%)-এ নেমে এসেছে। সারা বিশ্বে যেখানে কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহারের হার ২২% সেখানে বাংলাদেশে এই হার হচ্ছে ৩৯%। দেশব্যাপী দখল হয়ে যাচ্ছে নদ- নদী, খালবিল, ডোবানালা, জলাধার এবং চাষের জমি। বায়ু দুষণ, জল দুষণ, ভূমি দুষণ, শব্দ দুষণ, আলো দুষণ, প্লাস্টিক দুষণ , খাদ্য দুষণসহ নানারকম দুষণের প্রকোপে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যমান ক্রমশঃ নিম্নগামী হচ্ছে। তাই সম্প্রতি প্রকাশিত মানব পুঁজি(ঐঁসধহ ঈধঢ়রঃধষ)-র তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৬১ তম। মানব পুঁজির নির্ণায়কগুলো হচ্ছে- কৃশতা, খর্বতা, রক্তস্বল্পতা,বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা,দৃষ্টিস্বল্পতা, শ্রবনস্বল্পতা এবং রোগ সংক্রমণ প্রবনতা। সবমিলিয়ে দেশে মানুষের রোগ এবং ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে। দেশে প্রতি বছর আড়াই লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী সনাক্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দুই কোটির বেশি। যাদের মধ্যে আট লাখ রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। দেশের ৫ - ৬% মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত(এসোসিয়েশান ফর স্টাডি অব লিভার)। ডায়াবেটিস রোগে বিশ্বে দশম স্থানে বাংলাদেশ। এভাবে তালিকা দীর্ঘতর করা যায়।
আইন থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ বিধ্বংসী, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ভেজাল বিষযুক্ত এবং অনিরাপদ খাদ্যের বন্যায় দেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। এমতবস্থায় জনমানসে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে ‘দেশের আইন কেতাবে আছে প্রয়োগে নাই’।
চারঃ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা, ঘোষণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করার জন্য আমরা কয়েকটি দলের ২০০৮ এবং ২০১৪-র নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করি। এরমধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)-র ইশতেহারকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এসব ইশতেহার পাঠ করে পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারি ঃ-
১. প্রতিটি রাজনৈতিক দল অনুধাবন করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
২. রাজনৈতিক দলগুলো স্বাস্থ্যসেবা বলতে প্রধানত চিকিৎসাসেবা বুঝে থাকে।
৩. মানুষের সুস্বাস্থ্যের সাথে গবাদিপশুসহ অন্যান্য প্রাণী, কৃষি-উদ্ভিদসহ সকল বৃক্ষাদি এবং মাছসহ সব জলজ
প্রাণীর সুস্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত -- এই বিষয়টি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল উপলব্ধি করে না।
৪. আধুনিক পৃথিবীতে উন্নয়ন শুরু হয়েছিল ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পথ ধরে। কিন্তু সে উন্নয়নের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ফলে বিশ্ব এখন এক মহা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এখনকার ভাবনা হচ্ছে- প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্যকে আহত/ক্ষতিগ্রস্থ না করে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন। কিন্তু আমাদের ধারণা হয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নবতর উন্নয়ন ভাবনাকে আত্মস্থ করতে সমর্থ হয় নাই।
জলবায়ু পরিবর্তনের দরুণ দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে জেনেও সরকারগুলো তেমন দৃশ্যমান কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করে নাই। বরঞ্চ প্রতিটি সরকারের আমলে বন উজাড়, নদী-নালা-জলাভূমি দখল, নদী ভরাট করা ইত্যাদি চলমান থেকেছে। অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রনয়নের মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে একই সরকার রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপন শুরু করার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন বিনাশী একটি মহানিন্দনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। যেখানে সারা বিশ্ব শ্লোগান তুলেছে (কয়লা নয়) অর্থাৎ কয়লা নিষিদ্ধ কর। কারণ কয়লা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। কিন্তু দেশে কয়লা-তাপ ভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনের হিড়িক পড়েছে যেন। সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ লোকজন মনে করে ‘রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ভালো/কল্যাণকর কথা যা বলে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলোর বেশির ভাগ ভুলে যায়।’
সেমিনারে বক্তারা বলেন, সংসদে যারা নির্বাচিত হন তারা কেন এসব স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের কাজে নাক গলাবেন এ প্রশ্ন তুলে বক্তাগণ বলেন, সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো নির্দ্দিষ্ট এলাকার ভোটার নয়, বরং বাংলাদেশের যেকোনো এলাকার ভোটার হলেই চলে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হলে নির্দ্দিষ্ট এলাকার ভোটার হতে হয় কেনো এ প্রশ্ন আজ করার সময় এসেছে। তারা সংখ্যানুপাতিক আসন বন্টনের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এতে নির্বাচনী আচরণ ও নির্বচিনী পরিবেশ অনেকটা শান্তিপূর্ণ হতে পারে।
বক্তাগণ আসন্ন নির্বাচনে প্রচারেরে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও জোট সমূহকে পরিবেশ আইন মেনে চলার দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেবার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা এই পরিবেশের উপর বিশেষ নজর দিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।
সকল দল ও জোট যাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশকে সবার আগে স্থান দেন এবয় যুবসমাজকে যুক্ত করে এর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেন এবং তা পরবর্তী সময়ে যারাই সরকার গঠন করুকনা কেনো তারা যেনো এ বিষয়টি প্রতিপালন করেন সে বিষয়ে আমরা নজর রাখার বিষয়ে অভিমত ব্যাক্ত করেন এবং আগামী সরকারের একবছর পূর্তিতে তার কতটা করা হলো বা হলো না তা বিশ্লেষণ করা হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না হলে সমাজটা ভালো হবে না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মানসিক বিকাশ এবং শিশুকাল থেকেই তার চিন্তাশক্তি সুস্থ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য সকলের এক হয়ে কাজ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন বক্তাগণ।
বর্তমান ব্যবস্থায় প্রদর্শণবাদের কারণে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য আজ রোগাক্রান্ত উল্লেখ করে তারা বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও জোটসমূহ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে জনগণকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রদান করবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন। এই প্রদর্শণবাদ থেকে সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রাকৃতিক, সামাজিক ও মানবিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পবিবেশের সকল বিভাগেই আজ অরাজক পরিস্থিতি বিরাজমান।
ঢাকাসহ সারা দেশের খাল-বিল-নদী দখল ও দূষণের আজ বিলিন হবার পথে। পরিবহন ক্ষেত্রে আমরা সড়ক পথকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশকে মারাত্মক হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছি। অথচ রেল ও নৌপথে পরিবহন সুবিধা অনেক। এতে ধুলাদূষণ, শব্দদূষণ ও পরিবহন ব্যায় সড়ক যোগাযোগের তুলনায় অনেক কম।
গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশের মানুষের যা যা বৃদ্ধি হবার কথা ছিলো তার প্রত্যেকটি কমেছে, আর যেসব ক্ষেত্রে কমার কথা তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যানবাহনের গতি কমে শহরে এখন ৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। শব্দ দূষণে মারাত্মকভাবে শিশুসহ সকল বয়সের মানুষের শ্রবনশক্তি কমে যাচ্ছে। ইটিপি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নানা প্রশ্ন জনমানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
বর্তমান সময় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সময়। এসময় কেবল সাধারণ ভাবেই সব ভাবলে চলবে না উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, আমাদের দেশের আইন প্রণয়ণ ও নীতি নির্ধারণের জন্য জাতীয় সংসদ। এখানে আলোচনায় শতকরা মাত্র দশভাগ আলোচনা হয় আইন ও নীতি নিয়ে। বাকি কথা হয় এলাকার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, ভবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বরাদ্দ নিয়ে।