পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে যুদ্ধকালীন অবস্থার মতো জরুরি বিবেচনায় ক্রাশ প্রোগাম গ্রহণের দাবি
মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব সবচেয়ে বেশি শিশুবস্থায়। এর কারণ হিসাবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে- শিশুর বিপাকক্রিয়াসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অপূর্ণাঙ্গ ও অপরিপক্ক। তাই বায়ুদূষণ, জলদূষণ, ভূমিদূষণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণ, বিকরণ, বৃক্ষনিধন, জলাধার দূষণ, খাদ্যদূষণ যুক্ত হলে শিশুর স্বাস্থ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পরবে এবং নানারকম রোগের সৃষ্টি হবে। ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্র, ডেঙ্গু, টাইফয়েড থেকে শুরু করে লিভার, কিডনি, ফুসফুস, শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যাবতীয় রোগ, এর সাথে ক্যান্সার জাতীয় রোগসহ তাবৎ রোগের বেশির ভাগই মূলত এইসকল দূষণের কারণেই ঘটে থাকে। পরিবেশ দূষণের বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে আমাদের শিশুরা একটি অসুস্থ, পঙ্গু, ভঙ্গুর ও সম্ভাবনাহীন প্রজন্ম হিসাবে বেড়ে উঠবে। একটি দেশের জন্য এ অবস্থা হলো আত্মহননের মতো ভয়ংকর। তাই যে কোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে যুদ্ধকালীন অবস্থার মতো জরুরি বিবেচনায় ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন আজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সকাল ১১.০০টায়, পবা মিলনায়তনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর আয়োজিত “শিশু স্বাস্থ্যের উপর পরিবেশের প্রভাব”-শীর্ষক আলোচনা সভায় উপস্থিত বক্তারা। 
 
উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এবং মূল প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেন পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. লেলিন চৌধুরী । মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ডক্টর ফর হেলথ্ এন্ড এনভায়রনমেন্ট-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা: মো: আবু সাঈদ। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, সামস ইসলাম চৌধুরী, লেখক কামরুজ্জামান ভূইয়া, খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক রুনু আলী, সম্পাদক লাভলী চৌধুরী, সদস্য নূর-এ-জাহান, মোজাম্মেল আলমসহ খেলাঘর-এর ভাই বোনেরা।
 
বক্তারা বলেন, ভৌত পরিবেশের প্রধান দূষণগুলো হলো- বায়ুদূষণ, জলদূষণ, ভূমিদূষণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণ, বিকরণ, বৃক্ষনিধন, জলধার দূষণ, খাদ্যদূষণ ইত্যাদি। এগুলোর প্রভাবে শিশুর স্বাস্থ্যে নানা নেতিবাচক প্রভাব পরে এবং নানারকম রোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের জানা রোগ যেমন- ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্র, ডেঙ্গু, টাইফয়েড থেকে শুরু করে লিভার কিডনি ফুসফুসসহ শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যাবতীয় রোগ, ক্যান্সার জাতীয় রোগসহ তাবৎ রোগের বেশির ভাগই মূলত   ভৌত পরিবেশ দূষণের জন্যই হয়ে থাকে। সামাজিক পরিবেশের সাথে যুক্ত রোগগুলো প্রধানত হচ্ছে মানসিক এবং মনো-দৈহিক অসুস্থতা। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা আধুনিক মানুষের রোগের প্রায় ৫০ ভাগকে মনো দৈহিক বলে আখ্যায়িত করেছে। একটি শিশুর পারিবারিক পরিবেশ শিশুটির পুষ্টি, সংক্রামক রোগ ইত্যাদির সাথে যেমন জড়িত, তেমনি শিশুটির নীতিবোধ, দায়িত্বশীলতা, নিজেকে সংযত রাখা, সময়ানবর্তিতা, আবেগের ভারসাম্য ইত্যাদির সাথেও প্রবলভাবে যুক্ত। বিদ্যালয়ের পরিবেশে শিশুর সামাজিকরণ ঘটে। খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে ইতিবাচক প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠে। সামাজিক পরিবেশ শিশুকে পরিপূর্ণ সামাজিক প্রাণীতে উন্নীত করে। তাকে সুস্থও রাখে। জনপদে পর্যাপ্ত গাছপালা, জলাধার, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, সামাজিক উৎসব ইত্যাদি শিশুর শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
 
অন্যদিকে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লাখ শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত। তথ্যটি দিয়েছে পিডিয়াট্রিক্স নেফ্রলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (চঘঝই)। বাংলাদেশ লিভার ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত তথ্যে জানা যায় দেশে এককোটির মতো মানুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে একটি প্রণিধানযোগ্য সংখ্যা হচ্ছে শিশু। বিশ^ব্যাপি চালানো বায়ুর মান পরীক্ষা (অরৎ ছঁধষরঃু ওহফবী অছও)-র জন্য চালানো গবেষণায় দেখা যায় ঢাকার বাতাস হচ্ছে "ঊীঃৎবসবষু টহযবধষঃযু” বা অতি অস্বাস্থ্যকর। বিশে^ ২য় বায়ু দূষিত নগর হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এজন্যই ঢাকার শিশুদের শ^াসতন্ত্রীয় রোগ হু হু করে বেড়ে চলেছে। এছাড়া লাগামহীন শব্দদূষণের কারণে শিশুরা বধির প্রজন্মে রূপান্তরিত হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র পরিচালিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঢাকার বেশির ভাগ স্থানে শব্দমাত্র যেমন থাকা উচিত তার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। নগর ও জনপদে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষ তার চারপাশটিকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টিকে ভাবনালোকে ধারণ করেন না। সম্প্রতি ডেঙ্গুজ¦রের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব আমাদের পরিচ্ছন্নতার সামগ্রিক অবস্থাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। স্কুল গুলোতে খেলার মাঠ নেই। মাঠ-পার্ক-খলবিল-নদীনালা-পুকুর সব দখল হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস চলে যায় শিশুর পা মাটির স্পর্শ, সুর্যালোকের ছোঁয়া পায় না। সুস্থ বিনোদনের অভাবে শিশুরা গ্যাং কালচার, নেশার জগতে ডুবে যাচ্ছে। এভাবে প্রতিটি বিষয়ে নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে। তবে মোদ্দা কথা হলো বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারলে আমাদের শিশুরা একটি অসুস্থ, পঙ্গু, ভঙ্গুর ও সম্ভাবনাহীন প্রজন্ম হিসাবে বেড়ে উঠবে। একটি দেশের জন্য এ অবস্থা হলো আত্মহননের মতো ভয়ংকর। এটা হতে দেয়া যায় না। তাই সামগ্রিক পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনার কাজটি শুরু করতে হবে এখন, হ্যাঁ এখনই।
 
সুপারিশ সমূহ:
১. সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধকে যুদ্ধকালীন অবস্থার মতো জরুরি বিবেচনা করে অতি জরুরি ভিত্তিতে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হোক। একই সাথে একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে সেটাকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে হবে।
 
২. প্রাথমিক, উচ্চ ও মহাবিদ্যালয়, সবধরনের মাদ্রাসাসহ সকল শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সব ছাত্রছাত্রীকে প্রতিদিন একঘন্টা খেলার ক্লাস করতে হবে।
 
৩. দখলকৃত মাঠ, পার্ক, নদীনালা, খালবিল, পুকুর উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হোক।
 
৪. সবার আগে শিশু- এই নীতিকে মূলমন্ত্র করে শিশুর বিকাশবান্ধব সমাজ ও দেশ গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
 
৫. শিশুর বিকাশ বিরোধী কোন কিছু সংঘটিত হচ্ছে কিনা তা তদারক করার জন্য একটি শিশু কমিশন গঠন করা হোক। যাকিছু শিশুবান্ধব সেসব সুপারিশ তৈরি এবং যাকিছু শিশু বিকাশ বিরোধী সেসব চিহ্নিত করা এই কমিশনের প্রধান দায়িত্ব হবে। শিশু অধিকার রক্ষার জন্য এই কমিশন ‘ওয়াচ ডগ’ হিসাবে ভূমিকা পালন করবে।