জনস্বাস্থ্য ও রপ্তানী বৃদ্ধির স্বার্থে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সকল খাদ্য ও পানীয় নিয়মিত পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ করা প্রয়োজন
খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও, খাদ্যের নিরাপদ মান উন্নয়নে কার্যক্রম ও অগ্রগতি কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফলে অনেকে অর্গানিক/জৈব উপায়ে কৃষি উৎপাদন করলেও, ভোক্তারা মান নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন। যার ফলে অর্গানিক কৃষিজাত পন্যের ব্যাপক চাহিদা  থাকা সত্ত্বেও জৈব কৃষির উৎপাদন ও বাজার আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত নিয়ন্ত্রন করতে সকল  খাদ্য ও পানীয় নিয়মিত পরীক্ষা ও জনসম্মুখে তা প্রকাশ করা জরুরী। খাদ্যের মানের ব্যাপক ভিত্তিক পরীক্ষা না হলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা দুরুহ। জনস্বাস্থ্য ও রপ্তানী বৃদ্ধির স্বার্থে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সকল খাদ্য ও পানীয় নিয়মিত পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ করা সময়ের দাবী। তাই পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাসফ ও বারসিক সহ ১৪ টি সংগঠনের উদ্যোগে আজ ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, শনিবার, সকাল ১১.০০টায়, জাতীয় জাদুঘরের সামনে “ জনস্বাস্থ্য ও রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত কর” -দাবীতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
 
নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ)’র সভাপতি মো: হাফিজুর রহমান ময়না-এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ এর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, সম্পাদক ফেরদৌস আহম্মেদ উজ্জ্বল, নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, বারসিক’র সমন্বয়ক মো: জাহাঙ্গীর আলম, বানিপা’র সভাপতি প্রকৌ. মো. আনোয়ার হোসেন, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রে’র মহাসচিব মাহাবুল হক, বিডিক্লিক এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, সামাজিক আন্দোলন সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক হুমায়ন কবির হিরু, বাংলাদেশ ট্যুরিষ্ট সাইক্লিং’র সমন্বয়ক রোজিনা আক্তার, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট’র প্রকল্প কর্মকর্তা মো: আতিকুর রহমান, গ্রিণফোর্স’র আহসান হাবিব, বাংলাদেশ যুব সমিতি’র সভাপতি মো: আক্তার হোসেন, বাংলাদেশ বাস্তুহারা লীগ’র সাধারণ সম্পাদক রাশেদ হাওলাদার প্রমুখ। 
 
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ আয়তনে ছোট ও দুর্যোগপূর্ণ দেশ হলেও বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে বর্তমানে ধান, মাছ ও সবজি ইত্যাদি উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রচলিত ও প্রায় অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ভিত্তিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার দাপটে অর্গানিক/জৈব কৃষিজাত পন্যের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জৈব কৃষির উৎপাদন ও বাজার আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফসলে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারে খাদ্য দূষিত হচ্ছে। একইসাথে মজুতদার, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা খাদ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক তথা ফরমালিন, ক্যালসিয়াম, কার্বাইড, ইথোফেন, কীটনাশক, কাপড়ের রং, পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেলসহ নানা রকম ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপকরণ, হরমোন এবং এন্টিবায়োটিক খাদ্যে মিশানো হচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যেও নানা ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক মিশানো হচ্ছে। এর ফলে প্রায় সকল খাদ্য ও পানীয়তে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে মারা যায় ৯১ হাজার ৩০০ জন। কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় তিনগুণ মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে। ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৭ জন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। যার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট। বিশেজ্ঞরা মনে করেন,  এধরনের রোগ এবং মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে খাদ্য ও পানীয়তে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি। ফলশ্রতিতে জনস্বাস্থ্য আজ মারাত্বক হুমকির মুখে। একই সাথে আমাদের দেশের কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষনের অভাব এবং যথাযথ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক খাদ্য শস্য নষ্ট কিংবা অপচয় হয়। এতো অপচয় হওয়া স্বত্তেও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কারণে এ রপ্তানি বাণিজ্যও আজ  মারাত্বক হুমকির সম্মুখীন। 
 
বক্তারা আরো বলেন, জমির মাটি থেকে খাবার থালা অবধি খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি। খাবার নিরাপদ কিনা এ নিয়ে নিয়মিত খাদ্য পরীক্ষাটাও জরুরি। আমরা যেমন খাবারে কোনো ভেজাল চাই না। তেমনি আবার ফরমালিন-কার্বাইড বা ক্ষতিকর কোনো উপাদান খাবারে মিশে থাকুক তাও চাইনা। আবার খাদ্য উৎপাদনের পরিবেশ এবং কোন ধরণের শস্য থেকে খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে তাও পরখ করে দেখতে চাই। প্রতিদিন দেশে কমছে কৃষিজমি এবং প্রাকৃতিক পানির উৎসস্থলগুলো। আমরা কৃষিজমি ও জলাভূমিকে বাঁচাতে পারছি না। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক বাধ্য হয়ে অধিক খাদ্য ফলানোর নামে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করছে প্রাণ সংহারী বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। ক্ষতিকর কীটনাশক, আগাছানাশক কিংবা ছত্রাকনাশক মাটির অণুজীব থেকে শুরু করে শামুক-কেঁচোসহ নানা উপকারী পতঙ্গ মেরে ফেলছে। দূষিত করছে সামগ্রিক পরিবেশ। ফলে মানবস্বাস্থ্যসহ অন্যান্য প্রাণবৈচিত্র্য ক্রমেই হুমকীর মুখে পড়ছে। জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে তা শেষ পর্যন্ত জলাশয়ের পানিতে গিয়ে মিশছে। এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছের বৈচিত্র্য। পাশাপাশি জলজ জীব ও জলচর পাখিদের জন্যও  খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে। 
 
 
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ২০১৩ সনের ১০ অক্টোবর দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ অনুমোদন করে। এই আইন বাস্তবায়নের জন্য নিরাপদ খাদ্য বিধিমালা ২০১৪ তৈরি হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও ২০ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৫ সনের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। একইসাথে ২০১৮ সনে অনুমোদিত হয়েছে ‘নিরাপদ খাদ্য (স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ) প্রবিধানমালা ২০১৮’। এই প্রেক্ষাপটে দেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন দিন দিন বাড়তে শুরু করেছে এবং প্রতি বছর দেশ থেকে প্রচুর পরিমান আম, সবজি, মাছ, আলুসহ বিভিন্ন ধরণের কৃষিপণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।
 
আজ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)সহ মোট ১৪ সংগঠন জনস্বাস্থ্য এবং রপ্তানী বৃদ্ধির স্বার্থে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য নিস্মোক্ত দাবীসমূহ্ সরকারের কাছে পেশ করছে:
সুপারিশসমূহঃ 
 
১. সকল খাদ্য ও পানীয় নিয়মিত পরীক্ষা ও ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
২. ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। এবং শুধুমাত্র শহরের বিপণিবিতান নয়, একেবারে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন নজরদারিতে আনতে হবে। 
৩. নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে মাটি ও পানি দূষণ বন্ধ করতে হবে। দেশে নিষিদ্ধ কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার ও বিক্রি বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে খাদ্যের মান নিয়মিত পরীক্ষা করে জনগণকে জানাতে হবে।
৪. মাঠ থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সকল পর্যায়ে খাদ্যকে কীটনাশকসহ সকল প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত রাখতে হবে।
৫. নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও প্রচারণা চালাতে হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষিকে প্রকৃত কৃষকের কাছে রেখে তাদের দক্ষতা রাড়াতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। 
৬. নারী, আদিবাসী ও ভিন্ন ভিন্ন কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষকের লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৭. নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং ভোক্তা অধিকার আন্দোলনকে আরো জনবান্ধব এবং যুববান্ধব করে সক্রিয় করতে হবে।
৮. দূর্যোগ ও জলবায়ুগত সংকট মোকাবেলায় দেশের অঞ্চল ও শস্যফসলের জাতের বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে খাদ্যের বহুমাত্রিক আঞ্চলিক ব্যবহার বাড়াতে হবে।  এককভাবে মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে অন্যান্য প্রাণ ও প্রজাতির খাদ্য ও পরিবেশকে বিনষ্ট করা যাবে না।
৯. দেশের চাহিদার অতিরিক্ত নিরাপদ খাদ্য বিদেশে সহজভাবে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ বিশ্বের দরবারে দেশের মর্যাদা বাড়ানের উদ্যোগ নিতে হবে।