ট্যানারি সরালেও বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত হবে না
ঘটনাবলী
খবর
হাজারীবাগের ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে সরিয়ে নিলেও বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত হবে না। বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য হাজারীবাগের ট্যানারি আগে ৫০ শতাংশ দায়ী হলেও এখন মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দায়ী বলে মনে করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বুড়িগঙ্গায় শুধু ট্যানারির বর্জ্যই ফেলা হয় না। ওয়াসা, গার্মেন্টস শিল্প, টেক্সটাইল মিল ছাড়াও অন্যান্য কলকারখানার বর্জ্যও বুড়িগঙ্গায় যায়। আবু নাসের খান জানান, নন পয়েন্ট সোর্স থেকেও নানা ধরণের বর্জ্য ফেলা হয়। নন পয়েন্ট সোর্স বলতে বোঝায় বাড়ি, গাড়ি ও রাস্তা ধোয়া বর্জ্য মিশ্রিত পানি। যার শেষ গন্তব্য বুড়িগঙ্গা। যতদিন পর্যন্ত এসব উৎস থেকে সৃষ্ট বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা বন্ধ না হবে, ততদিন বুড়িগঙ্গার পনি দূষিত হতে থাকবে। কাজেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি পুরোপুরি সরে গেলেও বুড়িগঙ্গা পুরোপুরি দূষণমুক্ত হবে না। হাজারীবাগের ট্যানারি সরিয়ে নিলে বুড়িগঙ্গা কতখানি দূষণমুক্ত হবে, জানতে চাইলে আবু নাসের খান বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারি না থাকলে বুড়িগঙ্গার দূষণ কমবে মাত্র ২৫ শতাংশ। বাকি ৭৫ শতাংশ দূষণ কিন্তু থেকেই যাবে।
সাভারের ট্যানারি স্থানান্তর বিষয়ে আবু নাসের খান বলেছেন, ওটি একটি পরিকল্পিত শিল্প নগরী হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠবে ট্যানারি পল্লী। কিন্তু সেখানেও পরিবেশের সমস্যা হবে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার কার্যকর হলেও এলাকা পরিবেশ মুক্ত হবে না। কারণ সাভারের ট্যানারি শিল্প নগরীতে স্থাপিত কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারে (সিইপিটি) লবণ পরিশোধনের কোনও ব্যবস্থা নেই। কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে প্রচুর পরিমাণে লবণ ব্যবহার করা হয়। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সময় যদি এই লবণ পরিশোধন করা না হয়, তাহলে তা পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন আবু নাসের খান।
রাজধানীতে নির্মিতব্য ফ্লাইওভারগুলো নাগরিক জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, জানতে চাইলে আবু নাসের খান বলেন, এসব ফ্লাইওভার যদি যানজট নিরসনের লক্ষ্যে হয়, তাহলে ঠিক আছে। তবে সাধারণ নাগরিকদের যাতায়াত সমস্যা সমাধানে এই ফ্লাইওভারগুলো তেমন কোনও কাজে আসবে না। কারণ, রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনও কারণে কমবেশি পায়ে হাঁটেন বা হাঁটতে চান। ফ্লাইওভারের ওপরে বা নিচে কোথাও কিন্তু মানুষ পায়ে হাঁটতে পারবে না। যাত্রবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার তার দৃষ্টান্ত। রাজধানীর প্রায় ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষ পাঁয়ে হাটার পরিবেশ পেলে তারা গাড়ি ব্যবহার করবেন না। তাই যানজট নিরসনে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও যাতায়াত ব্যবস্থায় ফ্লাইওভারগুলো উল্লেখযোগ্য কোনও প্রভাব ফেলবে না।
কেমন যাতায়াত ব্যবস্থা চান জানতে চাইলে আবু নাসের খান বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থায় ইতিবাচক ফল পেতে রেলকেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা দরকার। রাজধানীতে এসে কাজ শেষ করে যেন একজন মানুষ নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা রেখে পরিকল্পনা নিতে হবে। এর জন্য রেল ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
আবু নাসের খান বলেন, আগামী ২০ বছর পরে রাজধানীতে গাড়ির পরিমাণ বাড়বে ১০ থেকে ১৫ গুণ। এ সংখ্যা কমিয়ে আনতে হলে রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে হবে। এর জন্য শিক্ষা, হাসপাতালের উন্নয়ন প্রয়োজন। দেশব্যাপী ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ভালো হাসপাতাল থাকলে রাজধানীতে চাপ কমবে। রাজধানীতে বসবাসকারী একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা অভিজ্ঞ শিক্ষক যদি ক্লাস নিয়ে বা রোগী দেখে স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীতে ফিরতে পারেন তাহলে জেলা শহরগুলোয় ভালো হাসপাতাল বা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কর্ম পরিকল্পনা প্রয়োজন। এর অংশ হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ৮ লেনে এবং জেলা শহরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত করতে ৪ লেন বা ৬ লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন।
সরকারের ১০০টি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে আবু নাসের খান বলেন, এই গুলো তো একদিনে গড়ে উঠবে না। তবে সিদ্ধান্তটি চমৎকার। এটি সরকারের দেশব্যাপী পরিকল্পনা। এটি যখন বাস্তবায়ন হবে তখন সারাদেশের অর্থনৈতিক চেহারা বদলে যাবে। গ্রামের অবকাঠামো বদলে যাবে। গ্রামের নাগরিকদের জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন আসবে। কাজেই ১০০টি অর্থনৈতিক জোনকে কার্যকর করতেই সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে।
এই মুহূর্তে মেট্রোরেলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আবু নাসের খান বলেন, আমি মেট্রোরেলের পুরোপুরি বিপক্ষে নই। তবে এই মুহূর্তে বিপক্ষে। রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু করতে যে টাকা ব্যয় হবে তা দিয়ে দেশব্যাপী রেলের উন্নয়ন করা যায়। তাই রাজধানীতে এই মুহূর্তে মেট্রোরেল না করে দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ উন্নয়ন করলে সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হবেন। রাজধানীর কাজ শেষ করে রেলের মাধ্যমে নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে রাজধানীতে সাধারণ মানুষের চাপ কমবে। এক সময় হয়তো তড়িঘড়ি করে মেট্রোরেল করার প্রয়োজনও কমে আসবে। পরে সুযোগ সুবিধা মতো রাজধানীতে মেট্রোরেল করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলে সারাদেশের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। যার ফলে মফস্বল থেকে একজন মানুষ সকালে রাজধানীতে এসে কাজ শেষ করে বিকেলে রাজধানী ছেড়ে চলে যেতে পারবেন।
আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে পরিবেশ খাতে কেমন বরাদ্দ চান- জানতে চাইলে আবু নাসের খান বলেন, বাজেটে বরাদ্দের আগে পরিকল্পনা চাই। বাজেটে প্রকল্প নয়, কর্ম পরিকল্পনা প্রয়োজন। যা হবে সবাইকে একত্রিত করে সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা। তবেই সুফল পাওয়া যাবে। রাজধানীতে ওয়াসা কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পরে টিঅ্যান্ডটি কাজ করতে এসে রাস্তা খোঁড়ে। টিঅ্যান্ডটি কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পর আবার তিতাস গ্যাস লাইনের কাজ করতে রাস্তা খোঁড়ে। এগুলো হয় সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা না থাকার কারণে। যে কারণে সারাবছরই রাজধানীতে চলে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি।
আপনার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা কী জানতে চাইলে আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশসম্মত, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ দেখে যাওয়াই আমার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন