চিকুনগুনিয়ার বিস্তারে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই
“প্রতিকার নয় প্রতিরোধে অগ্রাধিকার, চিকুনগুনিয়াসহ রোগ প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা”-শীর্ষক এক আলোচনা সভা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে আজ ২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১টায় পবার নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ইদানিং ঢাকাসহ সারাদেশ ব্যাপী মহানগরে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুসহ সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ বিস্তারের বিষয়টি আলোচনা করা হয়। সেখানে উঠে আসে এবারে চিকুনগুনিয়া মহামারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ ভূমিকা পালন করে নাই। তারা একদিকে যেমন রোগ বিস্তার রোধে ব্যর্থ হয়েছে অন্যদিকে জনগণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করে নাই। যথাসময়ে সতর্কবার্তা পাওয়ার পরেও ব্যাপক জনভোগান্তি এবং বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির ভার দেশ ও জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন এর ভূমিকা যথাযথ নয় বরং তারা প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে অবহেলা করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সোয়াইন ফ্লু-এর কারণে ছয় শতাধিক মানুষ ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে। দেশে ডেঙ্গু জ্বরেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বার্ড ফ্লু, নিপাহ জ্বর, এইচ আই ভি/এইডস, ঔষধ প্রতিরোধী টিবি ইত্যাদি রোগ ছড়িয়ে পরার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। এসব রোগগুলো প্রতিরোধযোগ্য। একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এই কমিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার এবং বিপর্যয় ঘটলো সেটি খুঁজে বের করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করবে। যেন ভবিষ্যতে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অবহেলা করার দুঃসাহস কেউ দেখাবে না।
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরীর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, পবা’র সদস্য রাজিয়া সামাদ, সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ ও নিশাত মাহমুদ, সদস্য সামসুল ইসলাম চৌধুরী, কায়সার আহমেদ প্রমুখ।
 
সভা প্রধান আবু নাসের খান বক্তব্যে বলেন, দেশে একটি নীরব ধীর গতির গণহত্যা চলছে। ২০১০ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, ৯৮.৭% এর মধ্যে অন্তত একটি অসংক্রামক রোগের (হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়বেটিস) ঝুঁকি (ৎরংশ ভধপঃড়ৎ), ৭৭.৪% এর মধ্যে অন্তত দুটি ঝুঁকি এবং ২৮.৩% এর মধ্যে অন্তত তিনটি ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে ১২ লক্ষ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। প্রতিবছর ২ লক্ষ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ১.৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। জাপানিজ জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি (জেজেসিও)-র তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের দেহে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটে চলেছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যা নিওপ্লাসিয়া নামে পরিচিত। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকবে ২ কোটি ১৪ লাখ মানুষ।
 
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ২০১৫ সালের গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭১ লাখ। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে ৩,৮২,০০০ মানুষ পঙ্গু হয় এবং ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়। বর্তমানে দেশে ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এ সংখ্যা। যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়া যায় মাত্র কয়েক হাজার রোগীকে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে ৬০ ভাগ রোগীকে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানচেটে বলা হয়- ২০১৩ সালে ১ লাখ ৭৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় স্ট্রোকে ও ১ লাখ ৬ হাজার মানুষ হার্ট অ্যাটাকে এবং ২৮ হাজার মানুষ উচ্চ রক্তচাপ জনিত হৃদরোগে মারা যান। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান দুটি কারণের একটি হচ্ছে হৃদরোগ। 
দেশে প্রায় সোয়া দুই কোটিরও বেশি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। মানসিক রোগীর এই সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। ২০১১ সালে মানসিক রোগীর সংখ্যা ছিল দেড় কোটি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ১৮ বছরের নিচে এবং ১৮ বছরের উপরের মানুষদের ওপর দুটি গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা যায়, ১৮ বছরের উপর ১৬% মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। আরেকটি গবেষণার তথ্য, ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে মানসিক রোগীর সংখ্যা ১৮%। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র সমীক্ষায় দেখা যায় ৭-১৫ বছরের বয়সী শিশু-কিশোরদের ৮% একাকি থাকতে পছন্দ করে, যার সংখ্যা ৩২ লাখ (দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরে)। শিশু-কিশোরদের এই একাকিত্ব তাদেরকে সামাজিক নানা অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিবে, যা আমরা ইদানিং অনেক বেশী দেখতে পাচ্ছি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬৪ লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।  
 
দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, শরীরচর্চা বা ব্যায়াম বা পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অনিয়ন্ত্রিত মাদক সেবন এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, অনিরাপদ খাদ্য অসংক্রামক রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। 
 
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি সরকারের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমান চিকিৎসা সেবা বরাদ্ধ ও কার্যক্রম রয়েছে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সে ধরনের কোন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। 
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, এডিস মশা চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করে। এ মশার বংশবিস্তারে নাগরিকদের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও রাজউক-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মশার বংশবিস্তার রোধে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এবছর আগাম বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ তাপমাত্রা এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের ফলে ভবিষ্যতে মশার প্রদুর্ভাব আরো বৃদ্ধি পাবে। মশাবাহিত রোগসহ সকল রোগের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিরুপন ও মোকাবেলায় পর্যাপ্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
 
প্রকৃতপক্ষে শতকরা ৮০% অপরিণত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও  ডায়াবেটিস এবং ৪০% ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। শুধুমাত্র জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে কিডনি রোগের ৬৮ শতাংশ মৃত্যু ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রাধান্য পাচ্ছে না। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
 
তামাক ব্যবহার বন্ধ, কায়িক পরিশ্রমবৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করার মাধ্যমেই এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইন ও নীতি প্রনয়ণ, অবকাঠামো তৈরি/পরিবর্তন, মানসম্মত খাদ্য নিশ্চিত, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য নিষিদ্ধ এবং জনসচেনতা উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু এ কাজগুলি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা এবং বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ের জন্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজন।
 
এমতাবস্থায় পবা’র পক্ষ থেকে নি¤েœাক্ত সুপারিশ সমূহ-
১. একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক। এই কমিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, কাদের গাফিলতিতে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার এবং বিপর্যয় ঘটলো সেটি খুঁজে বের করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করবে।
 
২. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জনস্বাস্থ্য বিভাগ গঠন করতে হবে এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে ও জনস্বাস্থ্য নীতিকে সকল আইন ও নীতির উপর প্রধান্য দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ এবং পরিবেশ রক্ষায় সকল মন্ত্রণালয়ে কার্যপরিধিতে সুনির্দিষ্টভাবে স্থান দিতে হবে।