জনস্বাস্থ্যে আসন্ন মহাদূর্যোগ রোধে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

জনস্বাস্থ্যে আসন্ন মহাদূর্যোগ রোধে
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে


বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যে কয়েকটি হুমকি মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্য ক্রমাগত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। বিভিন্ন পোল্ট্রি মৎসখাদ্য এবং পশুখাদ্যের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো থেকে শুরু করে মানুষের চিকিৎসার নামে অপরিকল্পিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগ চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ক্রমাগতভাবে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন অপারেশনের ক্ষত শুকানো ও রোগ সারাতে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ফলে জীবন আশংকা ও চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে আংশকাজনকভাবে। পবার একটি সমীক্ষার ফলে উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানীগণ আশংকা করছেন যে, এই অবস্থায় এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রোগ জীবানুর আর্বিভাব ঘটতে পারে। যার আক্রমণে মানব সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে পারে। জনস্বাস্থ্যে আসন্ন মহাদূর্যোগ রোধে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আজ ১৫ মার্চ ২০১৬, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে “অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স : মহাদূর্যোগের পদধ্বনি” শীর্ষক আলোচনা সভার বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, বিসিএসআইআর এর পুষ্টি ও খাদ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. ফরমুজুল হক, পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি বুরহান উদ্দিন আহমদ, উজ্জয়নী মহিলা সংগঠনের সভাপতি রাজিয়া সামাদ, প্রকৌশলী আবদুস সাত্তার প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, পৃথিবীব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রোগ জীবানু সংবেদনশীলতা কমে আসার ঘটনা পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্যাক্ট শিট নং ১৯৪ তে বলা হয়েছে ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৯ দেশে যৌনরোগ গনোরিয়ার চিকিৎসায় কোন ধরণের ঔষধ কাজ করছে না। এই ধারাবাহিকতাকে থামানো না গেলে দ্রুত গনোরিয়া চিকিৎসা অযোগ্য একটি রোগ হয়ে যাবে। ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা গউজ ঞই পৃথিবীব্যাপী বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সালে বিশ্বে ৪৮০,০০০ ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগি শনাক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে ঔষধ প্রতিরোধী রোগের তালিকায় যুক্ত হয়েছে ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ। মুত্রনালী বা মুত্রথলির ইনফেকশন, শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমন, সংক্রমিত ক্ষত ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক বেশি বেশি প্রতিরোধী জীবানু শনাক্ত করা হচ্ছে। সংক্রমিত রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে চিকিৎসকগণ অসহায় বোধ করছেন। বিশেষ করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর ইনফেকশন চিকিৎসায় প্রচলিত সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বলে প্রতীয়মান হয় তখন শেষ অ্যান্টিবায়োটিক হিসাবে কারবাপেনাম নামের ঔষধ ব্যবহার করা হয়। ঘটনাক্রমে এ ঔষধটিও রেজিস্ট্যান্ট হলে নিশ্চিত মৃত্যু ভিন্ন আর কোন পথ খোলা থাকে না।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণ বিশ্বব্যাপী অভিন্ন প্রায়। এগুলো হচ্ছে প্রধানত- অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধের অনিয়ন্ত্রিত ও নির্বিচার ব্যবহার,মাছ, হাঁস-মুরগি ও ছাগল-ভেড়া-গরুর প্রতিপালনে অপর্যাপ্ত ও অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ না করা। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে শতকরা ৮০ ভাগ জ্বরের ক্ষেত্রে এবং ৯০ ভাগ ডায়ারিয়ার রোগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। দুটো ক্ষেত্রের অধিকাংশ রোগিকে এই ঔষধ প্রয়োগ অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়। অ্যান্টিবায়োটিকের এই বিভিন্নমাত্রার অপব্যবহারের জন্য দায়ী রোগি নিজে (নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাওয়া), ঔষধের দোকানদার  রোগিকে যে চিকিৎসা দিয়ে থাকে), অপচিকিৎসক (সার্টিফিকেট ও লাইসেন্সধারী না হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া), অসতর্ক, অমনযোগী ও অবিবেচক চিকিৎসক।
বাংলাদেশে মৎস্য খামারে ১০ ধরন ও ৫০ শ্রেণীর রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। এসব রাসায়নিকের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও গ্রোথ এজেন্ট। প্রাণীসম্পদ খাতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের কিডনী, লিভার ও হৃদপিন্ডের ক্ষতিসাধন করছে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক ব্যাকটেরিয়া  খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে এবং তা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই দেশে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্বে  ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ৫০% কৃষি খাতে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে কৃষি খাতে ৬৩,২০০ মে.টন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হচ্ছে। যা ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে দাড়াবে ১০৫,৬০০ মে. টন। অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল র‌্যাজিস্টান্সের ফলে বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে ১(এক) কোটি মানুষ মারা যাবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র- পক্ষ থেকে অতি সম্প্রতি একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সেই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হচ্ছে। চিকিৎসকগণ রোগির শরীরের সংক্রমণ বা ইনফেকশন চিকিৎসার জন্য মল, মূত্র, কফ, রক্ত, ক্ষতস্থানের রস বা পুঁজ,গলার লালা, মলদ্বারের লালাসহ শরীরের বিভিন্ন নমুনা জীবানু শনাক্তকরণ ও সংবেদনশীলতা বা কালচার অ্যান্ড সেনসিটিভি পরীক্ষা করতে দিয়ে থাকেন। সংক্ষেপে এই পরীক্ষাকে সি/এস (প/ং)  বলে। ঢাকার তিনটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আগত রোগীদের বিভিন্ন নমুনার পরীক্ষা পরবর্তী ফলাফল সংগ্রহ করা হয়। সে ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে আমরা ঢাকায় অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্সের ধরণ ও প্রবণতা অনুধাবণে সচেষ্ট হয়েছি। নমুনা সংগ্রহের জন্য নির্বাচিত ল্যাবগুলো সরকার অনুমোদিত এবং সি/এস পরীক্ষা করার জন্য মানসম্মত। সমীক্ষায় অন্তর্ভূক্ত নমুনা সংখ্যা ৩০৫। সময়কাল ১৪-১১-২০১৫ হতে ১৩-০৩-২০১৬। আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল হচ্ছে-সমীক্ষায় অন্তর্ভূক্ত নমুনায় প্রাপ্ত ৫৫.৭০% অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। এর সরল অর্থ হচ্ছে ঢাকা শহরে যে রোগজীবানু দ্বারা সংক্রমণ ঘটে তার বিরুদ্ধে ৫৫.৭০% অ্যান্টিবায়োটিক কোন কাজ করে না। ফলাফলে কতগুলো পর্যবেক্ষণ হলো-
১.    ৩টি মলের নমুনা ও ৪টি ক্ষতের রসের নমুনায় কোন অ্যান্টিবায়োটিক সংবেদনশীল ছিল না অর্থাৎ অকার্যকর।
২.    ক্ষতস্থানের রস ও পুঁজে সবচেয়ে বেশি রেজিস্ট্যান্ট জীবানুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
৩.    গলার রসেও রেজিস্ট্যান্স জীবাণুর মাত্রাধিক্য লক্ষ্যনীয়।
৪.    নারীদের মূত্রে রেজিস্ট্যান্স জীবানু তুলনামূলক বেশি।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্টের জোয়ারকে থামাতে ব্যর্থ হলে একটি সময় আসবে জীবানুর বিরুদ্ধে সকল অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে যাবে। তখন পৃথিবীব্যাপী জীবাণুদের রাজত্ব শুরু হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যাকে বলেছে ঢ়ড়ংঃ ধহঃরনরড়ঃরপ বৎধ.। তখন অসহায় অবস্থায় মানুষের বিলুপ্তি দেখতে হবে। অতএব রাশ টানার সময় এখনই।

এ অবস্থা প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমাদের সুপারিশ :
ক্স    জনগণকে সচেতন করতে হবে। কেউ যেন নিজে নিজে কোন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধ কিনে না খায়। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করা।
ক্স    কোন ঔষধের দোকানদার, প্যারামেডিকস বা লাইসেন্স ও যথাযথ সনদবিহীন কেউ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় করতে পারবে না। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ করতে হবে।
ক্স    চিকিৎসকদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়ে জবাবদিহীতার আওতায় আনা।
ক্স    আইনী নজরদারী জোরদার করা।
ক্স    পোল্ট্রি ও পশু পালনের সাথে যুক্তদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বিধি শিখাতে হবে। তাদেরও জবাবদিহীতার আওতায় আনতে হবে। 
ক্স    এই কার্যক্রমে গণমাধ্যমকে যুক্ত করা।