পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে
নদ-নদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, দারিদ্র, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ু দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, মাএাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভ’গর্ভস্থ পানির অত্যাধিক উত্তোলনে বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকা বড় হচ্ছে। যেমন বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও ব্যাপক প্রাণহানী,  ঢাকায় থার্মোমিটারে যে তাপমাত্রা পাওয়া যায় বাস্তবে জনজীবনে  অনুভ’ত তাপমাত্রা  ৩ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সীমিত আয়তনের জনবহুল এদেশে পরিবেশ বিপর্যয়রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরী। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্ধ। আজ ৭ জুন ২০১৭, বুধবার, সকাল ১১টায় “পরিবেশগত বিবেচনায় বাজেট পর্যালচনা”-শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-এর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান এর সভাপতিত্বে এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পবা’র সম্পাদক শামীম খান টিটো, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, ব্যারিষ্টার নিশাদ মাহমুদ, সুবন্ধন সামাজিক কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি হাবিবুর রহমান, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুল হক মাহাবুব, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, মো. ইব্রাহীম হোসেন, সৈয়দ সাগিরুজ্জামান শাকীক, বানিপা’র ইঞ্চি. মো. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
 
মূল প্রবন্ধে প্রকৌ. আবদুস সোবহান বলেন, ১৯৯৫ সনের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত লোকবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত ল্যাবরেটরী থাকা আবশ্যক। অধিদপ্তরের ঢাকায় সদর দপ্তর, ৬টি বিভাগীয় ও ২১টি জেলা অফিস রয়েছে। লোকবল ৪৬৮ জন বৃদ্ধি করে ৭৩৫- এ উন্নীত করা হলেও বাস্তবে অনুমোদিত লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। জরুরীভিত্তিতে অনুমোদিত লোকবল নিয়োগ, বাকি ৪৩ জেলায় অফিস স্থাপন, প্রতিটি অফিসে আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত ল্যাবরেটরী স্থাপন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বরাদ্দ প্রদান। 
 
এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষেণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের উপক’লীয় বিভাগীয় অফিসগুলোর প্রতিটিতে পরিচালককে  প্রধান করে একটি শাখা খোলা। বিশ্ব ব্যাংকের ৭১ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে পরিবেশ অধিদপ্তরে বাস্তবায়নাধীন (২০০৯-২০১৮) ‘ক্লিন এয়ার ও টেকসই পরিবেশ (কেস) প্রকল্প’ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভ’মিকা রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাই বিশ্ব ব্যাংকের এধরনের প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকা সমীচিন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডে (বিসিসিটিএফ) ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া এবং সৌর বিদ্যুতের ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ কর আরোপ করা। এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামালের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। এলপিজি সুলভ করা হলে জ্বালানী কাঠের ব্যবহার কমবে। যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
 
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই রেল চলাচল নিশ্চিত করা। সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী রেল ওয়ার্কশপ আধুনিকায়নের মাধ্যমে ইঞ্জিন মেরামত এবং কোচ মেরামত ও তৈরি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। রেলের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি ধীর। সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী রেল ওয়ার্কশপ আধুনিকায়ন এবং প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন তরান্বিত করা। 
 
শুষ্ক মৌসুমে ইরি চাষের জন্য প্রচুর সেচ ও সারের প্রয়োজন। এতে ১২০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। সেচের পানি ভূ-গর্ভ ও ভূ-পৃষ্ঠ দু উৎস থেকেই নেয়া হয়। ফলে খাল-বিল, নদ-নদী শুকিয়ে গিয়ে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির  স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিগত ৩০ বছর (১৯৮১-২০১০) বার্ষিক গড় ১.৪% হারে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে বেশী নেমেছে রাজশাহীতে। যেসব এলাকায় পানির অভাব রয়েছে, সেসব এলাকায় ইরি চাষ পরিহার করে দেশীয় জাতের ধান চাষ এবং প্রকৃতি নির্ভর দেশীয় জাতের ধানের ফলন বৃদ্ধির  লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।
 
মোট বাজেট বরাদ্দের ১০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে দেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে মেডিক্যাল টেনোলজিস্ট ও নার্সের অপ্রতুলতা এবং যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জনগণ প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেডিক্যাল টেনোলজিস্ট ও নার্স নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং যন্ত্রপাতি তাৎক্ষণিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ প্রদান। তামাকজাত পণ্য বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়ানো এবং তামাকজাত পণ্য পস্তুতকারী করদাতার আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ সারচার্জ আরোপের প্রস্তার করা হয়েছে। এ সারচার্জ ৫ শতাংশ আরোপ করা। তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ানো ও সারচার্জ আরোপের পাশাপশি তামাক চাষকে আর্থিক সংশ্লেষের মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করতে করা।
 
এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে সক্ষম হবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। কিন্তু ৫ বছরেও সমুদ্র সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।  প্লাষ্টিক, পলিথিন, জাহাজের বর্জ্য, শিল্প ও পয়ঃ বর্জ্য  দ্বারা সমুদ্র  দূষণসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সমুদ্র খাত বিকাশে কাঠামোবদ্ধ পরিকলাপনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন জরুরী। সমুদ্র খাত উন্নয়নে ২০ থেকে ২৫ বছরমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
 
প্রস্তাবিত বাজেটে করনীতিতে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সবুজ কারখানায় কর সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা ও ইটিপি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবলের প্রয়োজন। এলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। দক্ষ জনবল তৈরীতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত বিদেশীদের জন্য বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। বিভিন্নখাতে বিশেষ করে পোশাক শিল্পে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের প্রায় ৬০ হাজার দক্ষ জনবল বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে। এতে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্্রা ব্যয় হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এ সকল জনবল তৈরী করতে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরসহ আগামী বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা।