ঈদের সময় অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগে গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। সামগ্রিক গণসচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের সক্রিয়তা বাড়িয়ে যত দ্রত পারা যায় ডেঙ্গু মশা নির্মূলে আমাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। সাময়িকভাবে সতকর্তার সাথে রাসায়নিক ব্যবহার করলেও বছরব্যাপি ডেঙ্গু নির্মূলে সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। আজ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের যৌথ উদ্যোগে পবা কার্যালয়ে ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিতে ঈদ যাত্রায় করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: লেলিন চৌধুরী, নারীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: বিলকিস বেগম চৌধুরী, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, বারসিকের পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ^াস, নীতি বিশ্লেষক ও আইনজীবী মাহবুবুল আল তাহিন, স্বাস্থ্য পরামর্শক জেবুন নেসা, প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন, শাকিল রহমান, বারসিকের সহযোগী কর্মসূচী কর্মকর্তা সুদিপ্তা কর্মকার প্রমূখ। আলোচনা সভায় ধারণাপত্র উত্থাপন করেন বারসিকের সহযোগী সমন্বয়ক মো: জাহাঙ্গীর আলম।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি সকলের ধারণার চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে আর এই সময়ে আমরা উদযাপিত করতে যাচ্ছি মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকা ছেড়ে বাড়ী যাচ্ছে, তাই এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি এবং সমন্বিতভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
নেতৃবৃন্দ আরও আরো বলেন, ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের জন্য এক জটিল দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এডিস মশাবাহিত এ রোগটি দুম করে এক দুই দিনে এমন লাগামহীন হয়ে যায়নি। নব্বই দশকের পর থেকে এই রোগের প্রাদূর্ভাব ধীরে ধীরে দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু সে সময় আমাদের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো এটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি। নগরের প্রকৃতি এবং পরিবেশ বিবেচনা না করে বরং সব কিছু সমূলে বিনাশ করে উন্নয়নের নামে বড় বড় দালান কোঠা তৈরীর করে এডিসসহ অন্যান্য মশা তৈরীর উপযুক্ত পরিবেশ নগরের মানুষেরাই তৈরী করে দিয়েছে। ফলে ডেঙ্গু সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। মোটাদাগে জনস্বাস্থ্য সেবায় সংকট এবং প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উদাসীনতা ডেঙ্গু বিষয়ে সাম্প্রতিক তর্কের ময়দান দখল করে আছে। আড়াল হয়ে পড়ছে পরিবেশগত সংকট ও বাস্তুসংস্থানের বিশৃংখলার বিষয়গুলো। যতটুকু জানা গেছে বাংলাদেশে এই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে মূলত: ঢাকা অঞ্চল থেকেই। নিদারুণ পরিবেশ-যন্ত্রণায় কাতর এই মহানগরকে আমরাই প্রতিদিন আমাদের জন্য বিপদজনক করে তুলছি। এই ছোট্ট নগর আর আমাদের দু:সহ দূষণ ভার সইতে পারছে না। আমরা নির্দয়ভাবে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ ও বালু নদীকে হত্যা করে চলেছি। ঊনিশ খালসহ সকল জলাশয় উধাও করে দিয়েছি। নতুন প্রজন্মের জন্য এক চিলতে ফাঁকা মাঠ কী ময়দান আমরা অবশিষ্ট রাখছি না। এই নগরের ক’টি উদ্যানই বা সুস্থ আছে? অল্প বর্ষাতেই এই শহর ডুবে ভেসে একাকার হয়ে যায়। লাগামহীন নগরবর্জ্যরে যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই শুরু হয় আমাদের প্রতিটি ভোর। ডেঙ্গু এখনও একটি মেগাসিটির রোগ হিসেবে পরিচিত।
পত্রিকার হিসাব মতে ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০০ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা যে এই সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী তা যে কেউ অনুমান করতে পারে। কারণ ডেঙ্গুর সব তথ্যতো পত্রিকাতে পাওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার নামী দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও অনেক মানুষ মৃত্যুবরন করেছেন। তাছাড়া সরকারী হাসপাতালেও অনেকে মারা গিয়েছেন এবং অনেকে আবার সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছে।
আগামী ১২ আগষ্ট ২০১৯ মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যারা শহরে বসবাস করেন তাদের অনেকেই নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে যাবে মা-বাবা,ভাই, বোন, আত্মীয়, পরিজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। যারা বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছেন তাদের অনেকেই ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে বহন করতে পারেন। অনেকে আবার জ¦র নিয়েও বাড়িতে যেতে পারেন। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত মানুষদের কোন প্রকার ভ্রমণ আরো অনেককেই বিপদে ফেলতে পারে, এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তিও ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারেন গ্রামে থেকে। এই ঈদের সময়টা আমাদের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ও নির্দেশনা অত্যন্ত জরুরি। মহামারী আকারে কোন রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকলে সরকার যেকোন ব্যক্তি মানুষের উপর সুনির্দিষ্ট বাধা নিষেধ আরোপ করতে পারেন জনস্বার্থে। তাই এক্ষেত্রে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। তাই ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ঈদযাত্রা নিয়ে সরকারের কাছে সুনিদিষ্ট নীতিমালার প্রসঙ্গটি আমাদের সামনে এসে যায়। আর যদি কোন মানুষ ভুলক্রমে এই রোগের ভাইরাস বহন করে বাড়িতে চলে যায় সেক্ষেত্রে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য তার কি ধরণের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হবে তা সুস্পষ্ট হওয়া জরুরি। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সকল ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থান চিহ্নিত করে সে মোতাবেক সরকারী উদ্যোগ নেয়া জরুরি। যেমন গুগল ম্যাপের মাধ্যমে আমরা কোন অঞ্চলে কতজন ডেঙ্গু রোগী অবস্থান করছেন আর তাদের জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে প্রকাশ করা দরকার। এই সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো :
* পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপন করার ক্ষেত্রে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা ও সকলের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাকে ভ্রমণ না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
* দীর্ঘ ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে বাসার কোন স্থানে যাতে পানি জমতে না পারে এমন বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে টব, এসির পানি, ফ্রিজের পানি ইত্যাদি।
* এই ছুটিতে গ্রাম এবং শহরের বাড়ির চারপাশ খুব ভালভাবে পরিস্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
* ভ্রমণে ব্যবহৃত সকল যানবাহন ঠিকমতো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও ডেঙ্গুমুক্ত আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
* স্থানীয় হাসপাতালের ফোন নাম্বার, ডাক্তারদের ঠিকানা ফোন নাম্বার, এ্যাম্বুলেন্স প্রাপ্তিস্থান স্থান আগে থেকে জনগন জানাতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে সরকারি হটলাইন ও যোগাযোগ নাম্বার সারদেশে প্রচার করতে হবে।
* স্থানীয় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য তাদের মোবাইল নাম্বার জনগনের কাছে সহজপ্রাপ্্য করতে হবে।
* এলাকার তরুণ ও যুব সম্প্রদায়কে নিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
*দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে ঔষধ, স্যালাইন, মশারী বিতরণ করতে হবে এবং সবার জন্য মশারী ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে।
* প্রতিটি এয়ারপোর্ট, বাসস্টান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, রেল স্টেশনগুলোতে মনিটোরিং জোরদার করতে হবে এরং সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে স্বাস্থ্যক্যাম্প নিশ্চিত করতে হবে।
* প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্ের ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসা সেল গঠন করতে হবে।