সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

পৃথিবীতে প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক বিদ্যমান এবং একে অপরের উপর পুরোপুরিই নির্ভরশীল। প্রকৃতির ভেতর মানুষই খাদ্যের উপর শতভাগ অন্যের (প্রাণীসম্পদ, বৃক্ষ-লতা, শস্য, মৃত্তিকা) উপর নির্ভরশীল। সুতরাং মানুষের প্রয়োজনেই পৃথিবীর সকল প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া জরুরি। খাদ্য শুধু মানুষের জন্য নয়। যে বৃক্ষ মানুষকে অক্্িরজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে সেই বৃক্ষের খাদ্যের নিশ্চয়তাও সম গুরুত্বপূর্ণ। তাই “সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ১১ জুন, শনিবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে একটি গোলটেবিল সংলাপের আয়োজন করা হয়।

পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং বারসিকের প্রোগ্রাম অফিসার ও পবার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় গোলটেবিল সংলাপে বক্তব্য রাখেন নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা, পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক পাভেল পার্থ। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত,উন্নয়ন কর্মি এম এ রাকিব,প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের দেলোয়ার জাহান,মাশরুম চাষী কিশোর বিশ্বাস কাজল, ইঞ্জিনিয়ার মো: সাত্তার, বাপার যুগ্ম-সম্পাদক মিহির বিশ্বাস,স্থপতি শাহিন আজিজ, মানবাধিকার  কর্মি রাকিবুল হক, শিক্ষক আব্দুল মান্নান পবার সহ-সম্পাদক মো: সেলিম, আমিনুর রসুল প্রমুখ।

প্রখ্যাত নিসর্গী ও লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে তার আলোচনায় বলেন, আমরা সভ্যতার এক সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি। সকল ধর্মেই সকল প্রাণের নিরাপত্তা ও ভালবাসার কথা আছে। কিন্তু আমরা মানুষ হিসেবে প্রকৃতির অন্য প্রাণসত্তাকে গণ করছি না। প্রকৃতির জীব ও জড় সকল সত্তার প্রতিই আজ আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। মানব প্রজাতি ও সভ্যতা টিকে থাকার স্বার্থেই আজ সকলের খাদ্য নিরাপত্তার দাবি তুলতে হবে। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে সকলেই সকলকে নিয়ে সমানভাবে টিকে থাকতে পারে।

বক্তারা বলেন- আমরা যখনি খাদ্যের কথা বলি, তখন কেবলমাত্র মানুষের খাদ্য ও পানীয় নিয়েই কথা বলি। বাদ থেকে যায় পাখি, মাছ, গাছ, কেঁচোসহ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণসত্তার কথা। এমনকি নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রসঙ্গেও বাদ থেকে যায় মাটি, জল, অরণ্য, পাহাড়ের খাদ্য নিরাপত্তার কথা। ষাটের দশকে প্রবর্তিত রাসায়নিক সার, বিষ, যন্ত্রচালিত সেচ ও উচ্চফলনশীল বীজের মাধ্যমে প্রবর্তিত ‘সবুজ বিপ্লবের’ মূল চিন্তাই ছিল কেবলমাত্র মানুষের জন্য অধিক হারে খাদ্য উৎপাদন। সেই খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে মাটি, পানি ও গাছের শরীরে ঢালতে হয়েছে বিপদজনক রাসায়নিক বিষ। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মজুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সকল স্তরে প্রচলন ঘটেছে হরমোন, কার্বাইড কি ফরমালিনের মত স্বাস্থ্যবিনাশী রাসায়নিকের। প্রকৃতি থেকে কেঁচো, শামুক, ব্যাঙ, কুঁচে, মাকড়সা, মৌমাছি, মাছ ও পাখিদের তাড়িয়ে আজ দাঁড়িয়েছে প্রকান্ড এক ‘খাদ্য কারখানা’ ও একতরফা বহুজাতিক বাণিজ্য। কেবলমাত্র মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে প্রকৃতির অপরাপর প্রাণসত্তার খাদ্যকে বিষাক্ত ও নির্মূল করা হচ্ছে। প্রকৃতির খাদ্যজালে তৈরি হয়েছে চরম বিশৃংখলা ও খাদ্য সংকট। মাটি ও পানির স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে, তাদের পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান না থাকলে কীভাবে মানুষসহ প্রকৃতির অপরাপর সদস্যদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে? আজ তাই প্রকৃতিতে সর্বত্র, সকল সদস্যই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবেশগত, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের পাশাপাশি সাম্প্রতিক জলবায়ু সংকটের এই সময়ে এই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরো চরম ও জটিল আকার ধারণ করছে। এটি আজ স্পষ্ট হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষের একার জন্য কোনো খাদ্য কোনোভাবেই নিরাপদ হতে পারে না এবং প্রকতির অপরাপর সদস্যদের বাদ রেখে কোনোভাবেই মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে না। তাই আজ আমাদের সকলকেই মানুষসহ প্রকৃতির সকল প্রাণের জন্যই খাদ্য নিরাপত্তার দাবি তোলা জরুরি। আর সকলের কাংখিত ও নিরাপদ খাদ্যের যোগফলই খাদ্য নিরাপত্তার পরিস্থিতি তৈরি করবে।

খাদ্য কোনোভাবেই কেবলমাত্র একটিমাত্র একক প্রজাতির উপর নির্ভর করে না, এর সাথে অপরাপর প্রজাতিরাও জড়িত। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চৈলতাছড়ার আদিবাসী খাসি পুঞ্জি খাদ্যের এমন বহুমাত্রিকতার একটা ছোট উদাহরণ টানা যাক। চৈলতাছড়ার জংগলে জন্মায় সহরহং নমের এক ধরনের বুনো ডুমুর। গাছটি খাসি আদিবাসীদের লতানো পান চাষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ফলটি পাকা অবস্থায় মানুষ খেতে পারে। ফলটি গাছে থাকা অবস্থায় পিঁপড়া ও ছোট পোকামাকড় এর থেকে রস খায়। বনের নিচুস্তরের পাখিরাও ডুমুর খায় এবং পাখিদের মাধ্যমে এর

বীজ বিসরন ঘটে এবং নতুন চারা গজায়। ডুমুর গাছটিও একসময় নানান পতঙ্গের খাদ্যে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে মরে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। একসময় মাটি থেকে খাদ্য নিয়ে বেঁচে থাকা মৃত ডুমুর গাছ তখন নিজেই মাটিকে খাদ্য জোগায়। ডুমুর বীজ থেকে গজানো নতুন চারাকে আবার মাটিই বড় করে তুলে। এভাবেই এক ডুমুরের সাথে মানুষ, পতঙ্গ, মাটি ও পাখিদের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। আলাদা আলাদাভাবে শুধুমাত্র পতঙ্গ বা পাখি বা মাটি বা মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা কী সম্ভব ? এমনকি প্রকৃতির এই জটিল খাদ্যজালের একটি সদস্য যদি খাদ্যহীনতায় পড়ে তবে এর প্রভাব কিন্তু সকলকেই টানতে হবে। এই উদাহরণ আমরা দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো প্রজাতির খাদ্য ঘিরে টিকে থাকা বৈচিত্র্যময় সম্পর্কের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো। কথা হচ্ছে আমরা প্রাণ ও প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য ও আন্ত:নির্ভরশীল সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করি কীনা, গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করি কীনা। নাকি খুব মোটাদাগে খাদ্যকে বারবার ওজনের দরে বা ক্যালোরির অংক দিয়ে হিসাব করে যাবো? এভাবে কী সকলের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়?

খাদ্য নিরাপত্তা এখনও পর্যন্ত একটি সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা নয়। একটি দেশের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতাকে খাদ্য নিরাপত্তা বোঝায় না। বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন, বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি, কৃষি সম্পর্কিত আইন ও নীতি, আয় সংক্রান্ত ধারা এবং সামাজিক নিরাপত্তাসমূহ সবই খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। এদেশে সমানে খাদ্য উৎপাদনের প্রাকৃতিক ভূমি কৃষি, জুমের জমিন, চারণভূমি ও জলাশয় দিনদিন দখল হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য চাহিদা মেটাতে তৈরী হচ্ছে বহুজাতিক খাদ্য বাজার এবং চুক্তিভিত্তিক কৃষি খামার। ‘আধুনিক পদ্ধতিতে’ অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কারনে মাটির পুষ্টি চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে আনুপাতিক হারে। তৈরি হচ্ছে নানাবিধ স্বাস্থ্যগত ও প্রতিবেশগত সমস্যা। তারপরও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ও দর্শন কেবলমাত্র মানুষের জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদন। খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে অধুনালুপ্ত লালমনিরহাটের পাটগ্রামের ছিটমহলের এক প্রবীণ বাঙালি কৃষকের কথা টেন আনা যাক। তিনি জানান, যখন কৃষকের হাতে খাদ্যের লাটিম থাকবে, কৃষক যখন তা নিজের মত ঘুরাতে আর বন্ধ করতে পারবে তখনইতো নিরাপত্তা হবে। একজন খাবে আরেকজন না খেয়ে থাকবে এটি কোনোভাবেই নিরাপত্তা হতে পারে না।

আমরা আজ সমাজ ও সভ্যতার এক সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি। মাতৃদুনিয়ার প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক ও একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার সূত্রগুলো থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছি অকৃতজ্ঞের মতো। প্রকৃতির ভেতর মানুষই খাদ্যের উপর শতভাগ অন্যের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষই খাদ্যের জন্য দাঙ্গা থেকে যুদ্ধ সবই বাঁধাতে পারে। উন্মত্ত, মরিয়া ও সহিংস হয়ে ওঠতে পারে। মানুষই শামুক, কেঁচো, পাখি, মাছ কি গাছের মুখের আহার কেড়ে একতরফাভাবে নিজের উদরপূর্তি করতে পারে। খাবারের জন্য মানুষের এই মরিয়া হয়ে ওঠাকে থামাতে হবে। প্রকৃতির অপরাপর প্রাণসত্তার উপর সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। শুধু মানুষের জন্য নয়, পৃথিবীর সকল প্রাণত্তার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাই মানুষকেই অধিকতর দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের এই বার্তা ও শপথ নিতে সকলের প্রতি আহবান জানানো হয়। সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে তুলি।