ইলেক্ট্রনিক্স বর্জ্যরে হুমকির মোকাবেলায় নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন জরুরী
ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের উৎপাদন, আমদানী, রপ্তানি, বিক্রয় এবং ব্যবহার পরবর্তী রিসাইকেল ও ডাম্পিং-এর জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। প্রযুক্তির সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে প্রযুক্তিগত পণ্যের ব্যবহার । তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সর্বত্রই প্রতিনিয়ত ইলেক্ট্রিকাল এবং ইলেক্ট্রনিক পণ্যের প্রতি বাড়ছে মানুষের নির্ভরতা। ডেস্কটপ পিসির জায়গা দখল করে নিয়েছে ল্যাপটপ ল্যাপটপ বদলে ট্যাব, ফিচার ফোনের বদলে স্মার্টফোন, সিআরটি মনিটরের জায়গা দখল করেছে এলসিডি, এলইডি মনিটর। এভাবেই নতুন নতুন সংস্করণের ডিভাইস বিদায় জানাচ্ছে পুরোনো ডিভাইসকে। তাই দিনদিন বাড়ছেই-বর্জ্যরে স্তুপ। পরিত্যক্ত টেলিভিশন, কম্পিউটার, কম্পিউটারের মনিটর, যন্ত্রাংশ, ল্যাপটপ, ল্যাপটপের ব্যাটারি, চার্জার ক্যাবল, প্রিন্টার, প্রিন্টারের টোনার, মোবাইল ফোন, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, চার্জার, ট্যাব, এনার্জি সেভিংস বাল্ব, টিউব লাইটসহ সবধরনের ইলেক্ট্রিকাল ও  ইলেকট্রনিক পণ্য এবং পণ্যের নানা যন্ত্রংশ, ইত্যাদি ই-বর্জ্যরে অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু আজও দেশে গড়ে ওঠেনি পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর এসব বর্জ্য সঠিক কালেকশন এবং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এসব বর্জ্য উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা, ডাম্পিংও রূপান্তর না করলে পরিবেশ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে ফলে পরিবেশ দূষণের চরম বিপর্যয়ের মুখে আজ বাংলাদেশ।
এমতাবস্তায় ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, বুধবার, সকাল ১১টায় পবা মিলনায়তনে “ইলেক্ট্রনিক্স বর্জ্যরে ব্যাপকতা ও অব্যবস্থাপনা, হুমকির মুখে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য”-শীর্ষক এক গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। 
 
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবা’র সদস্য ও পরিবেশ কর্মী রাজীব কুমার দত্ত। গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)-এর চেয়ারম্যান শাহারিয়ার হোসেন, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ)-এর সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়না, পবা’র সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, স্থপতি শাহীন আজিজ, ডা. ইমরুল হাসান ওয়ারসী, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি ও পবা’র সদস্য হাজী শেখ আনসার আলী প্রমুখ। 
 
পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান  উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে বলেন যুগের বাস্তবতার কারণেই শহর-গ্রাম সর্বত্রই প্রতিনিয়ত ইলেক্ট্রিকাল এবং ইলেক্ট্রনিক পণ্যের প্রতি বাড়ছে মানুষের নির্ভরতা। ই-বর্জ্যরে সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে বিষাক্ত কয়েক ধরনের রাসায়নিক  পদার্থ এবং বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক সামগ্রী। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেরই এই বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য রিসাইকেল করার মতো সামর্থ্য নেই। ফলে এরা নিজেরা পরিবেশ দূষণ ও মান বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সেই সব ই-বর্জ্য রপ্তানি করে দিচ্ছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আইন না থাকায় ডিজিটাল বর্জ্য ভাগাড় হতে চলেছে বাংলাদেশ। তাই অতি শীঘ্রই আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ই-বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।
 
ইএসডিও-এর চেয়ারম্যান শাহারিয়ার হোসেন বলেন বাংলাদেশে প্রচুর শিশু ও নারী শ্রমিক ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য সংগ্রহ ও রি-সাইকেল এর সাথে সম্পৃক্ত এবং তারা যথেষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। ইলেক্ট্রনিক পণ্যের বিক্রেতাদের বিক্রিত পণ্যের উপাদান সমূহ ও ডিস্পোজাল এর ব্যাপারে ক্রেতাদের গাইড লাইনের মাধ্যমে অবগত করা।
সেই সাথে তিনি বলেন, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের উৎপাদকারক বা রফতানীকারকদের পণ্যের লাইভ-সাইকেল ও গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। জাহাজ ভাঙা শিল্পের মাধ্যমে যে বিশাল পরিমাণে ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য প্রতিনিয়ত সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে তার ক্ষতিসমূহ বিবেচনা করে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করা।
 
রাজীব কুমার দত্ত তার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট ভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা কোনো ডাম্পিং স্টেশন না থাকার করণে এর প্রভাব আরো বিপদজনক অবস্থায়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন বড় বড় সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ইলকট্রনিক পণ্যগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ভেসেল কনভেনশনে স্বাক্ষর করছে। কনভেনশনের শর্তানুযায়ী ইলেকট্রনিক বর্জ্যবিষয়ক একটি নীতিমালা বাংলাদেশের তৈরি করার কথা। যে নীতিমালা  অনুযায়ী যে কোন হ্যাজারডাস পন্য আমদানি রপ্তানি নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও তা পুরোপুরি ভাবে তৈরি করেনি। এদিকে ই-বর্জ্যরে ভয়াবহতার কথা স্বীকার করে পরিবেশবাদীরা বলছেন, গেল এক দশকে ই-বর্জ্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংকটে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছে। 
 
 
সুপারিশ সমূহ:
০১। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে ই-বর্জ্যরে সঠিক ভাবে রিসাইকেল ও ডিস্পোজাল নিশ্চিত করা।   
০২। ই-বর্জ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে গ্রীণ ইকোনমি গড়ার সময় এসেছে। ই-বর্জ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বাড়বে তেমনি ঝুঁকি কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
০৩। সকল প্রকার অফিস ও প্রতিষ্ঠানে সকল ইলেকট্রনিক্স পণ্যের যথাযথ ইনভেন্টরি বা ডকুমেন্টেশন করা।
০৪। ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে ই-বর্জ্যরে প্রভাবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এজন্য ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়াও বিভিন্ন সেমিনার, কমিউনিটি মিটিং, লিফলেট বিতরণ ইত্যাদি সচেতনতার ব্যাপারে অবদান রাখতে পারে।
০৫। ই-বর্জ্যরে জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে দ্রুত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য কর্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যার মাধ্যমে সঠিক নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা।
০৬। প্রতিটি ইলেকট্রনিক পন্য উৎপাদনকারী অথবা আমদানীকারী-বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানকে ইলেকট্রনিক পণ্যের লাইফ সাইকেল শেষে কিভাবে সেই পণ্যের ওয়েস্ট ম্যানেজ করবে তা ডিফাইন করবে। 
০৭। দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন ও শহর গুলোতে ই-বর্জ্যরে নির্দিষ্ট কালেকশন, ট্রিটমেন্ট ও ডাম্পিংয়ের জন্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট অথবা ডাম্পিং স্টেশন এর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।
০৮। ই-বর্জ্যরে সকল অবৈধ আমদানি-রপ্তানির নিয়ন্ত্রণ করা।
০৯। উন্নত দেশের মতো উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ক্ষেত্রে ঞধশব-ইধপশ ঝুংঃবস এর আওতায়  আনা ।
১০। ব্যবহৃত বা পুরাতন ইলেকট্রনিক পণ্য সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে নির্ধারিত স্থানে জমা দেয়ার জন্য ব্যবহারকারীকে উৎসাহিত করা ও জবধিৎফ এর ব্যবস্থা  করা
১১। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে কার্যকরী সমন্বয়ের মাধ্যমে ই-বর্জ্যরে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করতে দায়িত্ববান হওয়া।