ঢাকাকে বাঁচাতে চারিপাশের নদীসমূহ ভরাট-দখলমুক্ত করতে হবে

২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। পানির সাথে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্পর্ক ও গুরুত্বকে সামনে তুলে ধরতে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ডধঃবৎ ধহফ ঔড়নং’. বিশ্বে ১.৫ বিলিয়ন কর্মজীবি মানুষ পানি সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। যা কর্মজীবি মানুষের অর্ধেক। আমাদের দেশের নদী, খাল, বিল, জলাধারসমূহের ক্রমসংকোচনের ফলে পরিবেশ, অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্যসহ কর্মসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ  হচ্ছে। পানি সম্পদ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা সম্ভব। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র একটি বিশেষজ্ঞ দল ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং ০১, ০২ ও ০৩ মার্চ ২০১৬ এই ৪ দিনব্যাপী মহানগরী ঢাকার চারিপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর দখল ও ভরাট পরিদর্শন করে। পরিদর্শনে অব্যাহত ভরাট দখলের চিত্র দেখতে পায়। ঢাকা মহানগরীর চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দখল, ভরাট ও দূষণরোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকাকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করতে হবে।  আজ ২১ মার্চ ২০১৬, সকাল ১১টায় পবা কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- পবার নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ,  মো: সেলিম, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, প্রকৌশলী মো: আবদুস সাত্তার, মাসুদুর রহমান প্রমুখ।

বক্তারা বলেন-বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী  আজ মৃত প্রায়। চারদিকের এই নৌ-পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়নগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এলাকার পয়ঃবর্জ্য এবং গৃহস্থালী বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য, হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারীসমূহের বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য বিশেষ করে টেক্সটাইল ডাইয়িং কারখানা, নৌযান নির্মাণ, মেরামত ও রংকরণ এবং নৌযানের বর্জ্য এসব নদী দূষণের অন্যতম কারণ। ঢাকা মহানগরী ও আশেপাশের এলাকার গৃহস্থালী বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যরে ৪০ শতাংশ যা প্রায় ৩ হাজার টন নালা-নর্দমা, খাল, জলাভ’মি হয়ে নদীতে পড়ছে। ঢাকা মহানগরীতে পয়ঃবর্জ্যরে পরিমাণ ১৪ লক্ষ ঘনমিটার। যার মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। হাজারীবাগের ট্যানারীসমূহ হতে দৈনিক ২২,০০০ কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এছাড়া মৌসুম ভেদে কঠিন বর্জ্যরে পরিমাণ ১০০ থেকে ২০০ মে. টন। যার অধিকাংশ নদীতে ফেলা হচ্ছে বা চলে যাচ্ছে। টেক্সটাইল কারখানার বর্জ্যসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে পড়ছে। নৌযানসমূহে সৃষ্ট বর্জ্য সংরক্ষণ বা ধারণ করার কোন স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে।

ঢাকায় জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল-এর পরিমান ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে  যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে  যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল যথাক্রমে ৩২.৫০% ও ৫২.৫০% হ্রাস পেয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন হাউজিং কোম্পানীগুলো নি¤œাঞ্চল ভরাট করছে। একই ভাবে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও নি¤œাঞ্চল ভরাট করছে। জলাশয় ও নি¤œাঞ্চল ভরাট ও দখলের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে এবং নগরবাসী প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধার শিকার হচ্ছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন - পবা ২০১৩ সালের জুন মাস থেকে নিয়মিতভাবে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী দখল ও ভরাট এবং নদীর বিভিন্ন স্থানের পানি পরীক্ষা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় পবার একটি বিশেষজ্ঞ দল ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং ০১, ০২ ও ০৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে ৪টি নদী দখল ও ভরাট পর্যবেক্ষণ এবং দূষণ পরীক্ষা করে। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে যে, একই এলাকা বার বার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ উচ্ছেদকৃত স্থান আবার ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে। ভ’মিদস্যুরা নদী-দখলের প্রকৃতি বদলে ফেলছে। প্রথমে কাঁচা, পরে সেমিপাকা  ও পাকা স্থাপনা দ্বারা নদীগর্ভ ও তীরভূমি দখল করা হচ্ছে।

করণীয় ঃ
১.    অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য  ও পরিবেশ বিবেচনায় ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ তুরাগ-বালু-শীতলক্ষ্যা ও অন্যান্য নদ-নদী রক্ষায় জরুরীভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনায় প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা।
২.    নদী-নালা, খাল-বিল দখল করে রাখা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা।
৩.    সিএস রের্কড অনুযায়ী বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সীমানা নির্ধারণ করে স্থায়ী পিলার স্থাপন করা। আদি চ্যানেলে প্রদত্ত ভ’মি বরাদ্দসমূহ সরকার কর্তৃক অনতিবিলম্বে বাতিল করা। ব্যক্তি ও সংস্থার নামে আদি চ্যানেলের রেকর্ডসমূহ আইন বহির্ভূত ঘোষণা করে সেগুলো বাতিল করা। সকল অবৈধ দখল এবং স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদ করা। খনন করে আদি চ্যানেলের গতি প্রবাহ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।
৪.    ঢাকার চারিদিকের নদী ও নদী সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ নদী খাল গুলোর জিপিএস ভিত্তিক জিআইএস তথ্য সমৃদ্ধ নদীর কাঠামো তীরবর্তী উপত্যাকার একটি সামগ্রিক চিত্র সংগ্রহ করতে হবে যার ভিত্তিতে বর্তমান ও ভবিষ্যত নদী ও নদী উপত্যাকা পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
৫.    নদীর তীরবতী স্তুপীকৃত ময়লা আবর্জনা, কাঁচামালের আড়তের ময়লা, কনন্সট্রাকশান কাজের আবর্জনা, সিটি কর্পোরেশন এবং ওয়াসা কর্তৃক কঠিন বর্জ্য ও পয়:বর্জ্য, শিল্পকারখানায় বর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করে নদী দখল, ভরাট ও দূষণরোধে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৬.    বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানি প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করা, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে পানি আনার ব্যবস্থা করা।
৭.    নদী তীরভূমির ৫০ মিটারের মধ্যে কোন স্থাপনাদি নির্মার্ণের পূর্বে বিআইডব্লিওটিএ’র ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। নদী তীরভূমির ২০০ মিটারের মধ্যে সকল ইটভাটা নিষিদ্ধ করা।
৮.    অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের উপর ব্রীজ, ওভারহেড লাইন, তলদেশে পাইপলাইন ও তীরভূমিতে অন্যান্য স্থাপনাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিওটিএ’র পুর্বানুমতি বাধ্যতামূলক করা। ব্রীজ যাতে নির্দিষ্ট উচ্চতার হয় তা নিশ্চিত ও নিচু ব্রীজ ভেঙ্গে নির্ধারিত উচ্চতার করা।
৯.    নদীর আশেপাশের ভূগর্ভস্থ স্তরের পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নদী থেকে পানির প্রবাহ কমে যায়। সেজন্য ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি উত্তোলন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা।
১০.    নৌ চলাচল ও বৃত্তাকার নৌপথ চালুর প্রধান বাঁধাসমূহ চিহ্নিত করে তা দূর করতে হবে। বিশেষ করে ল্যান্ডিং স্টেশনগুলো এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে যেখান থেকে সহজে যাতায়াত করা যায়।
১১.    আন্তর্জাতিক নদী আইনের আওতায় ভারতসহ সকল উজান দেশের সঙ্গে নদী সমস্যার সমাধান করা।