নির্মাণ কাজের নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ লাঘবে জবাবদিহিতা চাই
সম্প্রতি উন্নয়নের নামে যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ ও নির্মাণাধীন অবকাঠামোসমূহ জনদূর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা না করে এই সকল নির্মাণ জনগণের জন্য যেন মৃত্যু ফাঁদের ন্যায়। কিছুদিন পূর্বে ঢাকার মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একজনের মৃত্যু ও দুজন আহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পাশাপাশি দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিঘিœত হয়েছিল। এ ধরনের দুর্টনা এ নগরে একবার নয়, বহুবার ঘটেছে। তারপরও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত কোন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সেই সাথে অবকাঠামো তৈরিতে সার্বিক নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ কমাতে নির্মাণকারী সংস্থাগুলোর কোন পরিকল্পনা না থাকার কারণে দুঘর্টনা ও মৃত্যুর পাশাপাশি বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। তাই নির্মাণ কাজের নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ লাঘবে জবাবদিহিতা চাই। 
 
আজ ১৮ মার্চ ২০১৭ ইং শনিবার, সকাল ১১ টায়, শাহবাগস্থ ঢাবি’র চারুকলা অনুষদের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর উদ্যোগে “অবকাঠামো তৈরিতে সার্বিক নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ কমাতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশনের কার্যকর পদক্ষেপ চাই”- দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উল্লেখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে এবং বিসিএইচআরডি-এর সভাপতি মাহবুবুল হকের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সুবন্ধন সামাজিক কল্যাণের সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, পবা’র সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, বাংলাদেশ স্কাউট ও গাইড ফেলোশীপ-এর দপ্তর সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ, ডাব্লিউবিবি-ট্রাস্ট-এর প্রকল্প কর্মকর্তা আতিকুর রহমান, প্রত্যাশা’র সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম, পবা’র সদস্য রিফাত হাসান প্রমুখ।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্মাণকারী সংস্থাগুলো অবকাঠামো নির্মাণে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যান। যা জনগণের জন্য অত্যন্ত অনিরাপদ এবং জনদূর্ভোগের মূল কারণ। অবকাঠামো নির্মাণের সময় দুর্ঘটনাগুলো বারবার ঘটলেও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর টনক নড়ছে না। অপরিকল্পিত ও নি¤œমানের অবকাঠামোর ফলে দুর্ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে, বাড়ছে মৃত্যু পাশাপাশি বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। এছাড়াও এসকল অবকাঠামো নির্মাণের কারণেই এ নগরে ধূলা দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে ফলে নগরের জনগণ বিশেষ করে শিশুরা শ^াসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বের দূষিত বায়ূর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। সুতরাং অবিলম্বে নির্মাণ কাজের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং জনদূর্ভোগ লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে শুরু হয় সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি। এ বছরও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা রাজধানী জুড়ে চালাচ্ছে সড়ক খোঁড়াখুড়ি। কোথাও চলছে পয়োঃনিষ্কাশনের সংযোগ প্রশস্ত করার কাজ, কোথাও ওয়াসার পানি সরবরাহের নতুন সংযোগ বসানো কাজ। সংস্থাগুলো সড়ক খননের নিয়মনীতি না মানায় নগরবাসীর ভোগান্তি বেড়েছে বহুগুণ। তাছাড়া অন্যান্য অবকাঠামো যথা গ্যাস, পানি, বিদ্যৎ, টেলিফোন ডিস, ইত্যাদি সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানো, রাস্তা বা ফুটপাত তৈরী বা মেরামত করার জন্য রাস্তার খোড়াখুড়ি কাজ লেগেই আছে। এছাড়াও  ফ্লাইওভার এবং সম্প্রতি মেট্টো রেলের কাজও চলছে।
 
দুই সিটি কর্পোরেশন ও সেবা সংস্থা মিলে ঢাকার মূল সড়ক ও অলিগলির কম-বেশি পাঁচ শতাধিক স্থানে খোঁড়াখুড়ি চালাচ্ছে। এ সমস্থ কাজে সার্বিক নিরাপত্তা এবং জনদূর্ভোগ একেবারেই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। সার্বিক নিরপত্তা বিষয়টি তিনটি পর্যায়ে বিবেচনা করতে হবে- যথা: (১) অবকাঠামো তৈরি শুরুর পূর্বে (২) অবকাঠামো তৈরির সময় (৩) অবকাঠামো তৈরির পর। যেমন গ্যাস সরববাহ লাইন তৈরি করার জন্য রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করার পূর্বেই অন্যান্য সার্ভিস অবকাঠামোসমূহের যথা: ড্রেনেজ, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পানি এর উপর প্রভাব বিবেচনা করা, প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রাস্তা খোঁড়াখুড়ি বা সার্ভিস তৈরির সময় কর্মরতদের নিরাপত্তা, আশে-পাশে চলাচলকারী মানুষের ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি জনদূর্ভোগ কমানোর বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা। অনেক সময় অবকাঠামো তৈরির পরও নিরপত্তা বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কোন রকম নিরপত্তা ব্যবস্থাপনা ছাড়াই রাজধানীতে উড়ালসড়কের মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একদিকে জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা মানছে না অন্যদিকে বিধি মানতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এক ধরনের নির্লিপ্ত।
 
রাজধানীর সড়ক খনন ও পুনঃনির্মাণের নীতিমালা সব ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। নীতিমালা অনুযায়ী দুটি সিটি কর্পোরেশনের ‘ওয়ান স্টপ’ সমন্বয় সেল আছে, অথচ অনেক ক্ষেত্রেই সেল কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। নীতিমালা অনুযায়ী খননের অনুমতি দেওয়ার সময় সড়কের নিচে পানি, পয়ঃ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ড্রেনেজ ইত্যাদি লাইন পদ্ধতি, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বিবরণ, সময়সূচি, জননিরাপত্ত ব্যবস্থা, খননকৃত মাটি-রাবিশের অপসারণ ও প্রাথমিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অঙ্গীকারনামা জমা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। নীতিমালায় রয়েছে, খনন শুরুর ১৫ দিন আগে এলাকায় মাইকে ও লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার করা, প্রয়োজনীয় জননিরাপত্তামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া, সাইনবোর্ডে খননের উদ্দেশ্য এবং কাজ শুরু ও সমাপ্তির তারিখ প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে বলা হয়, অনিবার্য না হলে খননকাজ শুধু রাতেই হবে এবং সকাল হওয়ার আগে খনন করা মাটি বা রাবিশ সরিয়ে নিতে হবে। নীতিমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানে বলা হয়েছে, কোনো প্রধান সড়ক খননের জন্য একবার কোনো সংস্থাকে অনুমতি দেওয়ার পর অপরিহার্য না হলে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ওই সড়কে আর কাউকে খননের অনুমতি দেওয়া হবে না। প্রণীত হওয়ার শুরুতে কিছুদিন এই নীতিমালা অনুযায়ী খনন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও পরবর্তী সময়ে এটি একরকম হারিয়েই যায়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দু’ভাগ হওয়ার পর এই নীতিমালার অনুসরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
 
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বিধি দূরে থাক, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে প্রণীত জাতীয় নির্মাণবিধি (ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) মানা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাণবিধি আমেরিকান সোসাইটি অব টেস্টিং ম্যাটেরিয়াল (এএসটিএম) এবং ব্রিটেনের বিএস (ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড) বিধিতেও নির্মাণ পদ্ধতির মূল বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। 
 
তিনটি পর্যায়েই সার্বিক নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ কমানোর জন্য নীতিমালা ও আইন বা বিধিমালা রয়েছে। কিন্তু সেগুলির বাস্তবায়ন হচ্ছে না বা অবকাঠানো নির্মাণে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এর জন্য দায়ী মূলত নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কাজের তদারকী করার জন্য রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সামগ্রিকভাবে সিটি কর্পোরেশনসমূহ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর। যেমন পানি সরবরাহ লাইন তৈরি, মেরামতের জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং জনদূর্ভোগ কমানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ওয়াসা’র ঠিকাদারী কাজ ঠিকমত করছে কিনা তা দেখভাল করবে সিটি কর্পোরেশন ও মানুষের চলাচলের বা জনদূর্ভোগ এবং জননিরাপত্তা বিষয়টি তাদেরই দেখভাল করার কথা। কার্যত কোন প্রতিষ্ঠানই তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। কাজেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসহ তদারকী করার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন।
 
দাবি সমূহ:
১। দায়িত্ব অবহেলার জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
২। তদারককারী প্রতিষ্ঠানসমূহের যথা: ওয়াসা, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ইত্যাদির সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৩।  অবিলম্বে সকল নির্মাণ কাজের নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
৪।  অবকাঠামো নির্মাণে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের অবিলম্বে ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে হবে।
৫।  অবকাঠামো নির্মাণে সার্বিক নিরাপত্তা ও জনদূর্ভোগ হ্রাসে একটি সামগ্রিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে আইন প্রণয়ন করতে হবে ।