দিল্লীর মতো রেড এ্যালার্ট চাই না ধুলা দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই
শীত আসলেই ঢাকা মহানগরীতে ধুলা দূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। কারণ শুষ্ক মৌসুমে হাজার হাজার ইটের ভাটার পাশাপাশি মহানগরীতে সঠিক পরিকল্পনা ব্যতীত কোন সমন্বয় ছাড়াই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন ইত্যাদি সেবামূলক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তা-ঘাট খোঁড়া-খুঁড়ির পরিমান বৃদ্ধি পায়। ফ্লাইওভার তৈরির জন্য রাস্তা ও আশেপাশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে খোঁড়াখুড়ি, গ্যাস-পানি, বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের সময় রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, মাটি, বালিসহ এ ধরণের নানা সামগ্রী আচ্ছাদনহীন ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিস্কার করে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় নিয়ম না মেনে মাটি, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা, রাস্তার দু’পাশে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙ্গা, নতুন ভবন তৈরীর ইট-বালু-পাথর, মেশিনে ইট ভাঙ্গা, উড়াল সেতু নির্মাণ ইত্যাদি কাজেও নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা ও ফুটপাতে ফেলে রাখা এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া ধুলা দূষণের প্রধান উৎস। এ রকম অসংখ্য উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধূলা বাতাসে মিশে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে আমাদের নিঃশ্বাস। আজ ১৮ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১.০০টায় শাহাবাগস্থ চারুকলা অনুষদের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ ১৩ টি সংগঠনের উদ্যোগে ” ধুলা দূষণ প্রতিরোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ” -দাবীতে আয়োজিত মানববন্ধনে নেতৃবৃন্দ উক্ত দাবী জানান। 
 
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান সভাপতি সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, বিসিএসআইআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ড: প্রকৌ. মো: আবুল কাশেম, পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, মর্ডাণ ক্লাব এর সভাপতি আবুল হাসানাত, সুবন্ধন সমাজ কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব, ইয়ুথ সানের সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পী, বিডি ক্লিক-এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, বানিপা’র সভাপতি প্রকৌ. মো: আনোয়ার হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক হুমায়ন কবির হিরু, নাজিম উদ্দিন, মো. সেলিম, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বুরহান উদ্দীন, হাজী মো: আনসার অলী, ডাব্লিউবিবি’র সাবিনা ইয়াসমিন খান, ক্রিয়া সংগঠক শোয়েব হোসেন শামীম, সংগীত শিল্পী নূরিতা নূসরাত খন্দকার,এলিজা রহমান প্রমুখ। 
 
পবা’র চেয়ারম্যান বলেন, এবারও শীত আসার পূর্বেই ধূলা দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধূলা দূষণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ধূলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। রাস্তার পাশে দোকানের খাবার ধূলায় বিষাক্ত হচেছ প্রতিনিয়ত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণুমিশ্রিত ধূলা ফুসফুসে প্রবেশ করে সর্দি, কাশি, ফুসফুস ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানী, যক্ষ্মা, এলার্জি, চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা, বমি ভাব, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। শিশু, বৃদ্ধ ও অশুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ধূলা দূষণের ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য একটি মারাত্বক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। 
 
বক্তরা বলেন, ধূলার কারণে দোকানের জিনিসপত্র, কম্পিউটারসহ নানা ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঘরবাড়ি আসবাবপত্রসহ কাপড় চোপড়ে ধূলা জমে যেভাবে প্রতিদিন নগর জীবনকে নোংরা করছে, তা পরিচ্ছন্ন রাখতেও নগরবাসীকে নষ্ট করতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা ও বিপুল পরিমাণ পানি এবং ডিটারজেন্ট। আর এসব পরিষ্কারক দ্রব্যের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে নদী, লেক, জলাধারসমূহ। যা জলজ প্রাণীসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্রের জন্যও ক্ষতিকর। কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করতেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। অতিরিক্ত পানি, বিদ্যুৎ ও ডিটারজেন্ট ব্যবহারের ফলে পারিবারিকভাবে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধূলা দূষণের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৪,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ধুলা দূষণের কারণে বৃক্ষের সালোকসংশ্লেষণে বাধার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও ধুলা দূষণের ফলে মূল্যবান প্রতœতাত্বিক নিদর্শন, ইমারত, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন স্থাপনায় মরিচা পড়ে সেগুলোর আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে। এই সর্বগ্রাসী ধূলা দূষণে নগরবাসী অতিষ্ঠ, জনদূর্ভোগ চরমসীমায়। সুতরাং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। 
 
 
উল্লেখ্য সম্প্রতি দিল্লীতে বায়ু দূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আমরা দিল্লীর মতো রেড এ্যালার্ট চাই না। শহরের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই ধূলা দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইনের খোঁড়াখুড়ির সময় যাতে ধূলা দূষণ না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ভবন নির্মাণ এবং ভাঙ্গার সময় যথাযথ নিয়ম মেনে তা করতে হবে। ড্রেনের ময়লা এবং রাস্তা ঝাড়– দিয়ে ময়লা আবর্জনা জমিয়ে না রেখে সাথে সাথে অন্যত্র অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। গৃহস্থালী ও বাজারের ময়লা সঠিক নিয়মে দ্রুত সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ময়লা পরিবহণের গাড়িগুলোতে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করে ময়লা পরিবহণ করতে হবে। ধূলা দূষণের সাথে জড়িত দায়ী ব্যাক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সর্বোপরি ধূলা দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রয়োজনে লোকবল বৃদ্ধি ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে ধূলাদূষণ নির্মূলে এলাকাভিত্তিক করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। 
 
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে ধুলা দূষণের কারণে শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে ভর্তি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ ভয়াবহ ধুলা দূষণের শিকার হয়।
 
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সময়ে ঢাকা মহানগরীর একিউআই(এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক) তিনশতের উপরে। অনুমোদিত একিউআই ০-৫০ ভাল, ৫১-১০০ গড়ফবৎধঃব, ১০১-১৫০ ঈধঁঃরড়হ, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর, ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯১টি দেশের ১৬০০ শহরের মধ্যে পরিবেষ্টক বায়ু দূষণের দিক থেকে সবচেয়ে দূষিত ২৫টি নগরীর মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি নগরী (ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জ) রয়েছে। নারায়নগঞ্জের অবস্থান ১৭তম, গাজীপুর ২১তম এবং ঢাকা ২৩তম। 
 
বাংলাদেশে ব্যবহৃত ডিজেল ও পেট্রোলে সালফারের পরিমাণ যথাক্রমে ৫০০০ ও ১০০০ পিপিএম। নেপাল, ভারত ও চীনে ৩৫০ ও ১৫০ পিপিএম। মোটরযান নিঃসরণ মানমাত্রা বাংলাদেশে ইউরো ১, নেপাল, ভারত ও চীনে ইউরো ৩।
ইউরো ১- কার্বণ মনোঅক্সাউড ২.৭২ জি/কেএম, হাইড্রোকার্বণ ও নক্স ০.৯৭ জি/কেএম. পিএম ০.১৪ জি/কেএম এবং ইউরো ৩- কার্বণ মনোঅক্সাউড ০.৬৪ জি/কেএম, হাইড্রোকার্বণ ও নক্স ০.৫৬ জি/কেএম. পিএম ০.০৫ জি/কেএম। উন্নত মানের জ্বালানী আমদানি ও ব্যবহারের মাধ্যমে বায়ু ও ধুলা দূষণ আংশিক রোধ করা সম্ভব।
 
বায়ু ও ধুলা দূষণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরীসহ নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরকে বেইজিং, দিল্লী, তেহরান, প্যারিস-এর মতো ধূলা দূষণজনিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।
 
সুপারিশসমূহ 
ক্স পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সকল পরিসেবা কার্যক্রমের জন্য রাস্তা একবার খনন করা। পরিসেবার সম্প্রসারণ, সংযোগ, মেরামত ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খননকৃত মাটি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা;
ক্স ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা;
ক্স ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া;
ক্স নালা-নর্দমা পরিস্কার করার পর আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে না রাখা এবং দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেয়া; 
ক্স সকল আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে যানবাহন থেকে আর্বজনা রাস্তায় ছড়িয়ে না পড়ে; 
ক্স যানবাহন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত মানের জ্বালানী আমদানি ও ব্যবহার করা;
ক্স ধুলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা;
ক্স ধূলা দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা