ঢাকা মহানগরীর বায়ু দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে
পরিবেশ অধিদপ্তরের মান অনুযায়ী ঢাকার বায়ুমান এখন লাল ক্যাটাগরির যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বায়ু দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, ওয়াসাসহ কয়েকটি কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শীতকালে বায়ুদূষণ বিশেষ করে ধূলাদূষনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জরুরী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না বরং ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা জনগণকে আরো ভোগান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবেশ ও জনগণের কথা বিবেচনায় অচিরেই ঢাকা মহানগরীর বায়ু দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। আজ ২৫ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১টায় পবা মিলনায়তনে “ঢাকা মহানগরীর বায়ু দূষণরোধে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য জরুরী করণীয়”-শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, পবা’র সদস্য ইঞ্জি. তোফায়েল আহমেদ, সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, জাহাঙ্গীর যুবরাজ,  নাসফের ইঞ্জি.কামাল পাশা, পবা’র সদস্য মোস্তারী বেগম, জেবুন নেসা, এলিজা রহমান, এডভোকেট নাজনীন রহমান বেবী, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পীসহ আরো অনেকে। 
 
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে আমদানিকৃত কয়লা অত্যন্ত নি¤œমানের (সালফারের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম পক্ষে ৫ গুণ বেশি) এবং এসব কয়লা ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। আমদানিকৃত পেট্রোল এবং ডিজেলও অত্যন্ত নি¤œমানের। উন্নয়ন কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। কাজ ধীরগতিতে এগোয়, এর প্রভাবে বায়ু দূষণও বাড়ে।পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে গত ২২ নভেম্বর ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ২৬৯। পরিবেশ অধিদপ্তরের মান অনুযায়ী ঢাকার বায়ুমান খুবই অস্বাস্থ্যকর যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বায়ু দূষণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরীসহ নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরকে দিল্লীর মতো ধোঁয়াশাজনিত দূষণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। তিনি আরো বলেন, ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ২০১৩ সনের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী বায়ু দূষণরোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের উপর ন্যস্ত। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরকে আইন দুটি এনফোর্স করতে দেখা যাচ্ছে না। অধিদপ্তর শুধুমাত্র সচেতনতামূলক কার্যক্রম (মিটিং, সেমিনার, ওর্য়াকশপ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচার) করে যাচ্ছে। বায়ু দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর আইন দুটি এনফোর্স করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, শীত আসলেই ঢাকা মহানগরীতে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। মহানগরীর বায়ু দূষণের প্রধান উৎসঃ ঢাকার চারপাশের হাজার হাজার ইট ভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলা, যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণ কাজ, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের রাস্তা খোঁড়া-খুঁড়ি, মেগাপ্রকল্পের কাজ, মাটি ও বালি আচ্ছাদনহীন অবস্থায় পরিবহন, ড্রেন পরিস্কার করে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, মাটি ও বালুসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী দীর্ঘদিন রাস্তা ও ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙ্গা এবং মেশিনে ইট ভাঙ্গার ধুলা। বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত ধুলা ও ধোঁয়ার মিশ্রন ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। যা অত্যন্ত দূষিত। 
 
শীতকালে বাতাসে সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটারের (সূক্ষ কণা) (পিএম) মাত্রা বেড়ে যায়। তখন সর্দি, কাশি, হাঁপানী, এলার্জি, শ্বাসকষ্ট হয়। শিশু, বৃদ্ধ ও অশুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় বায়ু দূষণের ফলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূক্ষ কণার মাত্রা ২.৫ হলে তা ফুসফুস পর্যন্ত প্রবেশ করে আর মাত্রা ১০ হলে সেটা শ্বাসনালিতে আক্রমণ করে। এর ফলে অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের সমস্যা বেড়ে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে যাওয়ার ফলে ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। বাতাসে ভাসতে থাকা সিসা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। গত অক্টোবরে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে বছরে সাড়ে আট হাজার শিশু মারা যায়। কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুস, কিডনির জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সিসার কারণে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে।
 
বায়ু দূষণের ফলে সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্থ হয়ে গাছপালার বৃদ্ধি ও ফলন ব্যাহত হয়। বায়ু দূষণে একদিকে যেমন জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। সুতরাং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে বায়ু দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। উন্নত মানের জ্বালানী (কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল) আমদানি ও ব্যবহার এবং বিদ্যমান আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে বায়ু দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
 
শীতকালে বায়ুমন্ডলে উচ্চমাত্রায় আর্দ্রতা বিরাজ করায় এবং বায়ুপ্রবাহ কম থাকায় বায়ুর দূষিত উপাদানগুলো স্থায়ীভাবে অবস্থান করে। মার্কিন সংস্থা ন্যাশানাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন  (নোয়া) এর ১৫ নভেম্বর তারিখের বিবৃতিতে বলা হয়, বায়ুমন্ডলের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ স্তরের মাটির কাছাকাছি থাকার কথা। শীতল বায়ু যখন মাটির কাছাকাছি থাকে তখন উষ্ণ বায়ুকে জায়গা দিতে না পারায় শীতল বায়ু একটি ভারী ও দূষিত স্তর তৈরি করে। এর ফলে শীত বাড়ার সাথে সাথে দূষিত বায়ু আরো ঘনীভূত হয়। 
 
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ঘন ধোঁয়াশায় ঢেকে যাওয়ায় জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে। স্কুল বন্ধ, ফ্লাইট বাতিল, ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হচ্ছে। দিল্লিতে ধোঁয়াশা প্রতিরোধে গাড়ি চলাচলে জোড়-বিজোড় পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, পানিবাহী গাড়ির মাধ্যমে রাস্তায় পানি ছিটানো হচ্ছে এবং হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
 
১৯৯৫ সনের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় মহাপরিচালক পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং উপশমের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিকে আদেশ বা নির্দেশ প্রদান; যে সকল উৎপাদন প্রক্রিয়া, দ্রব্য এবং বস্তু পরিবেশ দূষণ ঘটাইতে পারে সে সকল উৎপাদন প্রক্রিয়া, দ্রব্য এবং বস্তু পরিহার করার জন্য সরকারকে পরামর্শ প্রদান করবেন। আইনের আওতায় স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাবে না এবং প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনের জন্য সংশ্লিষ্ট যানবাহনের চালক বা ক্ষেত্রমত মালিক বা উভয় ব্যক্তি দায়ী থাকবেন। মহা-পরিচালকের নিকট হতে পরিবেশগত ছাড়পত্র ব্যতিরেকে কোন এলাকায় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না।
 
সুপারিশ
 
ক্স নির্ধারিত মানমাত্রার সালফারযুক্ত কয়লা আমদানি ও ইটভাটায় ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে ইট প্রস্তুত;
ক্স উন্নত মানের জ্বালানী (পেট্রোল ও ডিজেল) আমদানি ও ব্যবহার করা ও যানবাহন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ;
ক্স পরিসেবার সম্প্রসারণ, সংযোগ, মেরামত ও নতুন সংযোগ স্থাপনের সময় রাস্তা খননকৃত মাটি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা;
ক্স রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা;
ক্স ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণের নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা ও ফুটপাতে বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা;
ক্স ধূলা সৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া;
ক্স নালা-নর্দমা পরিস্কার করার পর আবর্জনা রাস্তার পাশে জমিয়ে না রাখা এবং দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেয়া; 
ক্স সকল আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলা, সিটি করপোরেশন কর্তৃক আবর্জনা সংগ্রহ ও পরিবহনের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে যানবাহন থেকে আর্বজনা রাস্তায় ছড়িয়ে না পড়ে; 
ক্স কলকারখানায় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
ক্স পার্ক, লেক, জলাধার সংরক্ষণ করা, নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করা এবং অধিক পরিমাণে গাছ লাগানো;
ক্স বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করা;
ক্স বায়ু দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা