যাতায়াত দূর্ভোগ লাঘবে যানবাহন নয়, মানুষের যাতায়াতকেন্দ্রিক পরিবহণ নীতিমালা প্রণয়ন জরুরী
ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় নৈরাজ্য দীর্ঘদিনের। এ সমস্যার সমাধানে মানুষের যাতায়াতের সমস্যার সমাধানের চেয়ে যানবাহনের জট কমানোর বিষয়টি সবসময় প্রাধান্য দিয়ে পরিবহন পরিকল্পনা করা হয়েছে। ফলে যানের জট কমাতে বিগত কয়েক বছরে ফ্লাইওভার, ওভারপাসসহ বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রাইভেট গাড়ীবান্ধব বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গণপরিবহন সুবিধা বৃদ্ধি না করে প্রাইভেট গাড়ী বান্ধব অবকাঠামো ও বিভিন্ন সুবিধা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে যানজট আরও প্রকট হচ্ছে। সুতরাং মানুষের যাতায়াত দূর্ভোগ লাঘবে যানের জট কেবল কমানো নয় মানুষের যাতায়াত কিভাবে নির্বিঘœ হবে সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আজ ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, সকাল ১১ টায়, পবা কার্যালয়ে “যাতায়াতে জনদূর্ভোগ চরমে, প্রশ্নবিদ্ধ ব্যয়বহুল প্রকল্প; গণপরিবহনে নৈরাজ্য”- শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। 
 
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, পবার নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, পবার সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের মো: আতিকুর রহমান, সুজনের সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, পবার সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, এম এ কাশেম মাসুদ, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পী প্রমুখ। 
 
বক্তারা বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনে ইতিপূর্বে দিনের বেলায় ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ করা, আন্তঃনগর বাসের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা, বিভিন্ন সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করা, ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন করা, পথচারী পারাপারের জ্রেবা ক্রসিং বিলুপ্ত করে ফুটওভার ব্রিজ এবং ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। এ সকল কার্যক্রমের সঙ্গে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির প্রচলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া গত ২০ বছরে ঢাকায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অনেকগুলো মহাখালী, খিলগাঁও, খিলক্ষেত-কুড়িল বিশ্বরোড, মিরপুর-খিলক্ষেত, মগবাজার-মালিবাগ, তেজগাঁও-বিজয় সরণীসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফ্লাইওভার/এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক) নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লিংক রোড, খিলক্ষেত ও মিরপুর সংযোগ সড়ক, বসুন্ধরা আ/এ সড়ক, পরিবাগ খাল বিলুপ্ত করে পরিবাগ রোড (শাহবাগ-বাংলামটর লিংক রোড), সেগুনবাগিচা খাল বিলুপ্ত করে সেগুনবাগিচা রোডসহ অনেকগুলো নতুন সড়ক নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু, যানজট কমেনি। বরং যানজট বেড়েছে। 
 
অথচ গণমানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, রিক্সা চলাচল, বাস, স্কুটার সহ গণপরিবহন মাধ্যমগুলোর সুযোগ সুবিধা সংকুচিত করা হয়েছে। এ নগরের পরিকল্পনাকারী সংস্থা ও ব্যক্তিদের চিন্তায় বিষয়টি স্থান পায় না। হাঁটার কথা আসলে বিষয়টি হকারদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। অথচ ঢাকা শহরের মাত্র ৫/৬টি এলাকায় হকার ফুটপাত দখল করে আছে। অধিকাংশ রাস্তাই ফুটপাত চলাচলে উপযুক্ত নয়। অবাক হলেও সত্য, এ নগরে একটিও নিরাপদ পথচারী পারাপার নেই। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টর তথ্য অনুসারে ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লক্ষ ট্রিপ হয়। যার মধ্যে হাঁটার মাধ্যমে যাতায়াত হয় ১৭.৭২ শতাংশ এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে ৭.২২ শতাংশ। নগরীতে অধিকাংশ মানুষ হেঁটে যাতায়াত করলেও পরিকল্পনায় হাঁটাকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে যানজট, জ্বালানী দূষণ এবং দূর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিদিন পথচারীদের ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। ঢাকা শহরে মিরপুর, উত্তরা, গাজীপুর, পুরাতন ঢাকাসহ মোট ৬ টি এলাকায় গবেষণা করে দেখা গেছে ৪৪ শতাংশ জায়গায় কোন ফুটপাত নেই। পকিল্পনায় গাড়িকে প্রাধান্য দেয়ায় ঢাকা শহর আজ যানজটের শহরে রূপ নিয়েছে। টঙ্গী, উত্তরা, মিরপুর, গুলশান, মহাখালী এ সকল এলাকার হতে মতিঝিল এলাকায় সহজেই বিদ্যমান রেল অবকাঠামোর মাধ্যমে নিয়মিত যাতায়াতের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নগরে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন আগে ঢাকার চারপাশে সাকুলার রেল হওয়ার কথা থাকলেও এ বিষয়টি এখনো সমীক্ষা পর্যায়ে। ফ্লাইওভার তৈরির কারণে রেলে ৩য় ও ৪র্থ লাইন তৈরির কাজটি এগুচ্ছে না। অথচ ৩য় ও ৪র্থ লাইন তৈরি করা হলে, ঢাকা আসে পাশের এলাকা হতে শ্যাটল ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রী যাতায়াত করতে পারতো, তাদের রাস্তার উপর চাপ কমতো।
 
বর্তমানে ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, এ অবস্থা হতে উত্তরণে সরকারের দ্রুত দুটি নীতি গ্রহণ করা জরুরি। প্রথম নিয়ন্ত্রণ মূলক কার্যক্রম এবং দ্বিতীয় পরিবহন বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম। 
 
প্রথম নিয়ন্ত্রণ মূলক কার্যক্রমের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে সকাল ১০ হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দিনের বেলায় প্রাইভেট গাড়ীর গ্যাস সরবরাহ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ীর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিসহ একই পরিবারে একাধিক গাড়ীর রেজিষ্ট্রেশন ফি বৃদ্ধি করতে হবে।
 
দ্বিতীয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম হিসেবে প্রথমেই ঢাকার মানুষের যাতায়াতের সময়সূচী, মাধ্যম এবং গন্তব্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহণ করতে হবে। মানুষের পায়ে হেঁটে যাওয়ার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। গলির রাস্তায় রিকশা ও সাইকেল চলাচলের রাস্তাগুলোর সংস্কার এবং রিকশার নেটওয়ার্ক উন্নত করতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে পৃথক লেনে বাস চালু করার পাশাপাশি ঢাকার আশে পাশের এলাকা সাথে রেল যোগযোগ স্থাপন এবং ঢাকার চারপাশে রেল যোগযোগ স্থাপন। ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে করণীয় :
১. নগর ও পরিবহণ পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় করে যানবাহন নয়, মানুষের যাতায়াতকেন্দ্রিক পরিবহণ নীতিমালা প্রণয়ন করা।
২. শহরের অভ্যন্তরে যাতায়াত কমাতে মিশ্র এলাকা গড়ে তোলায় প্রণোদানা/উৎসাহ প্রদান।
৩. স্বল্পদূরত্বের যাতায়াতে হাঁটা, সাইকেল, রিকশার অযান্ত্রিক যানকে উৎসাহিত করা এবং এ লক্ষ্যে সমান্তরাল, প্রশস্ত ফুটপাথ নির্মাণ, রাতে ফুটপাথে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখ, পর্যাপ্ত গাছ লাগানো, পাবলিক টয়লেট স্থাপন
৪. পথচারীদের জন্য ফুটওভারব্রিজ/আন্ডারপাস এর পরিবর্তে সড়কে সমতলে পারাপারের (ক্রসিং) ব্যবস্থা করা।
৫. ফুটপাতে সম্পূর্ণরূপে প্রাইভেট কার পার্কিং নিষিদ্ধ করতে হবে। সর্বত্র জায়গা ও সময়ের মূল্যানুসারে পার্কিং ফি নির্ধারণ করা।
৬. শহরের সর্বত্র লেন এবং পৃথক সড়ক এর মাধ্যমে বাইসাইকেলে চলাচল ও স্ট্যান্ড এর ব্যবস্থা করা।
৭. শহরের সর্বত্র রিকশা চলাচলের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করা ও রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং রিকশার কাঠামোগত উন্নয়ন করা।
৮. বাসের জন্য আলাদা লেন চালু করাসহ পাবলিক পরিবহণের উন্নয়ন এবং প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা।
৯. বাসে উঠা-নামা নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দময় করতে বাস বে চালু করা
১০. প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্স সীমিতকরণ, আমদানীর ক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণ বাতিল করা, নগরের কেন্দ্র এবং বানিজ্যিক এলাকা প্রাইভেট কারমুক্ত করাসহ কঠোরতা অবলম্বন করা (নগরীর ব্যস্ত এলাকায় প্রাইভেট কার প্রবেশের জন্য কনজেশন চার্জ গ্রহণ)
১১. যথাযথভাবে পৃথক লেনের বাসের  সঙ্গে অযান্ত্রিক যান এবং পথচারীদের সুবিধার জন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
১২. ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে যে রেল যাতায়াত ব্যবস্থা রয়েছে, তার উন্নয়ন করতে হবে। বিশেষ করে নারায়নগঞ্জ, জয়দেবপুর, গাজীপুরসহ নিকটবর্তী জনবসতি শহরগুলোর সঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা দরকার। 
১৩. পুরোনো স্টেশন ফুলবাড়িয়াসহ শহরের অন্যান্য এলাকায় ঝঁৎভধপব রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
১৪. ঢাকার চারপাশের নদী ও অভ্যন্তরীণ খালগুলি সংস্কার করে সমন্বিতভাবে নৌ-পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।