“গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া বাবদ প্রত্যেক যাত্রীর মাসিক ব্যয় গড়ে পাঁচশত টাকা”
ঢাকার গণপরিবহনগুলো সবসময়ই ধারন ক্ষমতার অনেক বেশি যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করছে। সেই সাথে  বাসগুলোতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানো হচ্ছে কিন্তু নামানোর সময় চলন্ত অবস্থায় রাস্তার মাঝে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নামিয়ে দিচ্ছে ফলে যাত্রীরা মারাত্মক দূর্ঘটনা শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে মোটরযান আইনে প্রতিটি গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দৃশ্যমান স্থানে টানিয়ে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রায় সব বাসেই ভাড়ার এ তালিকা দেখা যায় না। একই রুটে চলা একেক কোম্পানি একেক হারে ভাড়া আদায় করছে। ঢাকার ৯৫-৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নৈরাজ্যের সাথে জড়িত। রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে অতিরিক্ত বাস ভাড়া বাবদ একজন যাত্রীকে মাসে তিন শত থেকে নয় শত টাকা ব্যয় করতে হয়। যা প্রতি মাসে গড়ে প্রায় পাঁচ শত টাকা।
 
আজ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, সকাল ১১ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ মোট ১৭টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে “রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনের নৈরাজ্য বন্ধ কর”-দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ-এর সভাপতি নাজিম উদ্দিন, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুল হক, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন-এর সভাপতি ইঞ্জি. আনোয়ার হোসেন, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী আনসার আলী, পবা’র সদস্য স্থপতি জুবাইদা গুলশান আরা, কামরুজ্জামান ভূঁইয়া, অমূল্য কুমার বৈদ্য প্রমুখ। 
 
পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের পাশাপাশি সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামানো ও উঠানো, যা অত্যন্ত বিপদজনক এবং প্রায় হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে। রাস্তার মাঝখান, রাস্তার মোড় ও সিগনালে বাস থামিয়ে রেখে অন্যান্য যান চলাচলে বাধা প্রদান করে যানজট সৃষ্টি করা হচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত আসন স্থাপন করা হয়। বাস-মিনিবাসের ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ না করার ফলে ব্যাপকভাবে শব্দ ও বায়ু দূষণ হচ্ছে। বাস-মিনিবাসের বডি, আসন, জানালা ও দরজা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত না করার ফলে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়, বিশেষ করে শীত ও বর্ষাকালে। রাজধানী ঢাকায় চলাচলকারী গণপরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের কোনো পরিবেশ নেই। বছরের পর বছর চলতে থাকা এসব অনিয়মের জন্য মূলত দায়ী বিআরটিএ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন, গণপরিবহন মালিক, চালক ও শ্রমিক। 
 
প্রকৌশলী আবদুস সোবহান আরো বলেন, প্রতিটি বাস ২০ শতাংশ আসন খালি নিয়ে চলবে - এমনটা ধরেই ভাড়া ঠিক করা হয়েছে। ফলে আলাদা করে সিটিং সার্ভিস চালু রাখা ও আলাদা ভাড়া নির্ধারণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। মালিকেরা চান অধিক মুনাফা। তাই সবার আগে প্রয়োজন মালিকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন। এছাড়াও ঢাকা মহানগরীর ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। 
 
অন্যান্য বক্তারা বলেন, ঢাকা মহনগরীতে বড় বাসের কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের কিলোমিটার প্রতি ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা। সর্বনি¤œ ভাড়া বড় বাসে সাত টাকা আর মিনিবাসে পাঁচ টাকা এবং এ ভাড়ায় দুই ধরনের বাসে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার ভ্রমনের সুযোগ আছে। কিন্তু তা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না তাই গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত কিংবা পুলিশের বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে মোটরযান আইন প্রয়োগ করতে গেলে মালিকেরা বাস-মিনিবাস চালানো বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। সরকার পিছু হটে আসে এবং অভিযান বন্ধ করে দেয়। মালিকেরা দ্বিগুন দাপটের সাথে তাদের ইচ্ছা মতো অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম করে যাচ্ছে। 
 
গত ১৬ এপ্রিল সিটিং সার্ভিস বন্ধে বিআরটিএ, পরিবহন মালিক সমিতি ও পুলিশ অভিযান শুরু করে। এ সময় পরিবহন মালিকরা প্রায় ৪০ শতাংশ বাস বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। বিআরটিএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বাস বন্ধ রাখা মালিকদের তালিকা করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু  বিআরটিএর এই বক্তব্যের বাস্তব কোনো প্রতিফলন দেখা যায় নি। মোটরযান আইনে বাস-মিনিবাসের চলাচল বন্ধ রাখতে হলে কতৃপক্ষকে আগে থেকে জানানোর নিয়ম। এর ব্যাত্যয় ঘটলে তা অনুমতির শর্ত লঙ্ঘন করবে। এর সর্বোচ্চ শাস্তি যানবাহনের অনুমতি বাতিল। এজন্য কাঊকে শাস্তি দেয়ার কোনো নজির নেই। বাস বন্ধ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী মালিকদের শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে তাঁরা কোন নির্দেশই মানবেন না।
 
ঢাকায় শতকরা ৯৩-৯৪ ভাগ মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে পায়ে হেঁটে, বাসে বা রিক্সায়। মাত্র ৬-৭ ভাগ মানুষ প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার করে। প্রাইভেট গাড়ীগুলো ঢাকার  রাস্তার শতকরা ৬৫ ভাগ দখল করে রাখে। ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করায় দ্রুত প্রাইভেট কার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা মূলত প্রাইভেট কারকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করছে। এছাড়া প্রাইভেট গাড়ির জন্য অবাধ লাইসেন্স বিতরণ ছাড়াও রয়েছে নানা সুবিধা। যেখানে সারা পৃথিবী জুড়েই প্রমাণিত যে যাতায়াত ব্যবস্থায় প্রাইভেট গাড়ি যানজটের অন্যতম কারণ। যানজটমুক্ত মহানগরীর জন্য গণপরিবহণ ব্যবস্থার নৈরাজ্য দুর করা জরুরী। আরামে, সূলভে সর্বত্র যাতায়াতে পর্যাপ্ত গণপরিবহন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ পরিবহন করা যায় এমন বাহনের সুযোগ বাড়াতে হবে। 
 
সুপারিশসমূহ
বিদ্যমান মোটরযান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং সময়োপযোগী মোটরযান আইন প্রণয়ন করা।
রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্য বন্ধে বিআরটিএ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। 
রাস্তার মাঝখানে বাসে যাত্রী উঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা।  
রাস্তার মাঝখান, রাস্তার মোড় ও সিগনালে বাস থামিয়ে রেখে অন্যান্য যান চলাচলে বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা। 
যানজটমুক্ত মহানগরীর জন্য গণপরিবহণ ব্যবস্থার নৈরাজ্য দূর করা।
অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত আসন স্থাপনকারী যানের মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
বাস-মিনিবাসের ইঞ্জিন, বডি, আসন, জানালা ও দরজা নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য মালিকদেরকে বাধ্য করা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক তা তদারকি করা। 
বিআরটিসিসহ বেসরকারি বাস সার্ভিস কর্তৃক সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা।  
অধিক মুনাফালোভী মালিকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করা।
গণপরিবহনের চালক ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সচেতন করা।
গণপরিবহনের চালক ও সহকারীদের পোষাক নির্ধারিত করে দেয়া এবং তাঁদের জন্য পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা।